একটি সেতু কেবল একপাড় থেকে অন্যপাড়ে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনকারী অবকাঠামো নয় বরং এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত বন্ধন সৃষ্টিকারী জড় কুটনীতিক। নদীর বিশালতাকে নৌযানে অতিক্রম করে দুটি অঞ্চলের আর্থ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিস্মায়নকে সমন্বয় করা ঠিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব হয় না। একটা সেতু সময়, শ্রম এবং উদ্যমকে বাঁচিয়ে বিচ্ছিন্ন দু’টি জনপদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ সৃষ্টি করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিনিময় সম্ভব হয় দেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত আন্তঃসংযোগ ও আদান প্রদানের মাধ্যমে। একটি প্রমত্তা নদীর নিয়মিত ফেরিকেন্দ্রিক পারাপার এবং তার মধ্য দিয়ে দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ অনেক বড় বাধা না হলেও স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক বিনিময়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমনটি বাংলাদেশে এতকাল হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং রাজধানী ঢাকাসহ চট্রগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আদান প্রদান সুদীর্ঘকাল কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে দক্ষিণ বাংলার সাথে ঐসব অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগের অভাবে।
দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলায় রয়েছে দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখা বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শতাধিক সক্রিয় আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গত কয়েকবছর ধরে শিক্ষা ও গবেষণার বিশ্ব রেংকিং এ সমগ্র বাংলাদেশে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটি। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও নিয়মিতভাবেই ভাল করছে। বিশেষত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আয়োজন, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমভাবে অংশগ্রহণ ও কৃতিত্ব দেখাচ্ছে।
অনুরূপভাবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিয়মিতভাবে সেমিনার, কনফারেন্স, আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন এবং ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ফোরামে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু সকল পর্যায়েই একটা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ বাধা ছিল যেন পদ্মার পাড়ে এসে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার এবং আনুষঙ্গিক বিড়ম্ভনার বিষয়টিতে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ একটা বাধাহীন এবং মুক্ত মননের বিষয়। সেখানে যদি বাধা, বিরক্তি আর দুর্বিষহ বিড়ম্বনা থাকে তাহলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে এবং হওয়াটা স্বাভাবিক। ফেরিতে করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলে যাওয়াটা যে একটা চরম বিরক্তি আর বিড়ম্বনার ব্যাপার ছিল সেটি সবাই স্বীকার করবেন। বিশেষত ফেরির জেটিঘাট পর্যন্ত ৫-৭ কিলোমিটারের সুদীর্ঘ গাড়ির জট, ফেরিতে প্রায় তিন ঘন্টা অযাচিত বসে থাকা, কখনো যাত্রীদের সাথে ফেরিতে বা ঘাটে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার এমনকি মারধরের ঘটনা, লঞ্চ বা স্প্রিড বোট পারাপারে দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানাবিধ অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে বলে আমার ধারণা।
এইসব নানা সমস্যা অতিক্রম করে অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে মুক্ত মনের মননচর্চা বা কিছু সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী কাজ করা কতটা সম্ভব হত সেটা কারো ভুলে যাওয়ার মত নয়। কাজ করা হতো ঠিকই তবে আশানুরূপ মনোযোগ ও মনোবল দিয়ে কতটুকু করা হতো বা করা যেত সেটা ভাবনার বিষয়।
সেখানে পদ্মাসেতু নিরবচ্ছিন্ন পদ্মাপারি এইসব বিড়ম্বনাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবর দিবে বলেই বাংলাদেশের মানুষ বিশেষত শিক্ষা ও সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে যারা লড়ছেন তারা বিশ্বাস করেন। এতকাল পদ্মানদী পাড়ি একটা স্বাভাবিক ভীতির কারণ ছিলো। অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেবল পদ্মাপাড়ি দেয়ার বিড়ম্বনার কথা ভেবে যাত্রা স্থগিত করেছে।
আমার মনে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথিতযশা অধ্যাপককে আমরা আমাদের ডিসিপ্লিনের মডারেশন বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। পাশাপাশি তাকে নিয়ে একটি সেমিনার করা যায় কিনা এমন পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু তিনি অকপটেই স্বীকার করলেন যে পদ্মাপাড়ি দিয়ে যাওয়া তার জন্য একটু কষ্টকর। তবে তিনি জানালেন যে, পদ্মাসেতু হলে তিনি খুলনা আসবেন। আবার ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আমাদের অনেক সহকর্মীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের মধ্যে যারা অংশগ্রহণ করেননি তাদেরও অন্যতম একটা অনীহার কারণ ছিল পদ্মানদী পাড়ি দেয়া সংক্রান্ত বিড়ম্ভনা। সুতরাং একটা নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার অভাবে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হত। এরকম দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশ এই জ্ঞান, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির সমন্বয় এবং সম্প্রসারণের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার অভাব বোধ করেছে। পদ্মাসেতু সেই বাধা দূর করে একটি স্বাভাবিক শিক্ষা সংস্কৃতির সরাসরি বিনিময়কে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করতে যাচ্ছে বলে আমাদের আশাবাদ। ভারতের লোহিত নদীর উপর নির্মিত ভূপেন হাজারিকা সেতু যেমন আসাম ও অরুণাচলের মধ্যে এক নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সমন্বয়ের সুযোগ করেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু যেমন উত্তরবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছে অনুরুপভাবে এই দুই সেতুর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে চলে যাওয়া পদ্মাসেতু বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও উৎকর্ষে এবং বিনিময়ে অবদান রাখবে। আর তখনই বাংলাদেশের উন্নয়ন আরো বেশি অর্থবহ হবে। পূরণ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)