আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক যুগেই নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। কোনো যুগ নবী-রাসুল থেকে খালি ছিল না। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হলেন আমাদের প্রিয় নবী ﷺ। তিনি সাইয়্যেদুল আম্বিয়া তথা নবী-রাসুলদের সর্দার। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
وَمَآ أَرْسَلْنٰكَ إِلَّا كَآفَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
হে রাসুল! আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি। -সুরা সাবা, আয়াতঃ ২৮
মহানবী (সা.)-এর নবুয়তকে শক্তিশালী করার জন্য অন্য নবী-রাসুলদের মতো তাঁকেও দেওয়া হয়েছে অগণিত মুজিজা। তন্মধ্যে অন্যতম মুজিযা হল মিরাজ।
ইসরা ও মিরাজের মধ্যে পার্থক্য
ইসরা অর্থ নৈশভ্রমণ, রাত্রিকালীন ভ্রমণ। আর মেরাজ অর্থ সিঁড়ি, ঊর্ধ্বলোকে গমন, সোপান, মই। মেরাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের কথা হাদিস দ্বারা আর ইসরা তথা নৈশভ্রমণের কথা কোরআন মজিদ দ্বারা প্রমাণিত। মক্কা মুকাররমা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর যেটা বোরাকের মাধ্যমে হয়েছিল, তাকে ইসরা বলে। মাইতুল মুকাদ্দাস থেকে আরশে আজীম পর্যন্ত সফরকে মিরাজ বলে। আবার উভয় সফরকে একত্রে মিরাজ বলা হয়। যে ব্যক্তি ইসরা ও মিরাজ অস্বীকার করবে, সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
মিরাজ কখন সংঘটিত হয়
মিরাজ কখন সংঘটিত হয়, এ ব্যাপারে অনেক মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তন্মধ্যে অগ্রগণ্য একটি মত হল নবুয়ত প্রাপ্তির একাদশতম বছরে কোন এক রাত্রিতে নবী করীম ﷺ কে সান্তনা প্রদানের নিমিত্তে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। কেননা ঐ বছর হুযুর ﷺ এর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হযরত খাদিজা রা. ও চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করেন। এই দুজনের ইন্তিকালের পর রসূল ﷺ খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। এজন্যই ইতিহাসে ঐ বছরটিকে বলা হয় عام الحزن তথা বেদনার বছর।
মিরাজের তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে মতভেদের কারণ হলো, ওই জামানায় যেকোনো কিছু ঘটলেই তার দিন-তারিখ লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রচলন ছিল না। কোনো রেকর্ড রাখা হতো না। আর যে সমস্ত রজনী বা দিনের সাথে ইসলামী শরীয়তের বিশেষ কোনো বিধান সম্পৃক্ত ছিল সেই দিন তারিখ গুলো সাহাবায়ে কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম আমলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে রাখতেন। কিন্তু মিরাজের রজনীতে উম্মতের উপর বিশেষ কোনো বিধান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আরোপিত হয়নি। এজন্য এর আসল দিন তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় না। বিধায় এ ব্যাপারে অনেক মতভেদ দেখা যায়।
মিরাজের সফরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
মিরাজের রজনীতে রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘরে শায়িত ছিলেন কিন্তু অন্তর জাগ্রত ছিল। এরই মাঝে আগমন করলেন হযরত জিবরাঈল আ.। তিনি নবীজীকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন যমযমের নিকট। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হল। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ। তাতে যমযমের পানি। জিবরাঈল আ. নবীজীর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজীর হৃদয়। যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন জায়গামত। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেওয়া হল নবীজীর কলব।
এরপর আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য সওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট। নাম বুরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে।
এভাবে নবীজী ﷺ মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। বুরাক বেঁধে রাখা হল পাথর ছিদ্র করে। যে পাথরে অপরাপর নবীগণ নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। নবীজী সেখানে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। নামায পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাঈল আ. নবীজীর সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজী দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাঈল আ. বললেন, আপনি (দ্বীনের) স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন।
নবীজী মদের পেয়ালা নেওয়ার পরিবর্তে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করায় জিবরীল আ. বলেন, আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৯৪
এরপর শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। জিবরাঈল নবীজীকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে গিয়ে দস্তক দিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, কে? বললেন, জিবরাঈল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হল, তার কাছে কি আপনাকে পাঠানো হয়েছে? বললেন, হাঁ। এরপর নবীজীকে সম্ভাষণ জানানো হল- মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে! খুলে দেওয়া হল নবীজীর জন্য আসমানের দরজা।
নবীজী প্রথম আসমানে গেলেন। সেখানে ছিলেন হযরত আদম আ.। জিবরাঈল পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবীজী হযরত আদমকে সালাম বললেন। বাবা আদম জবাব দিলেন। নবীজীকে সাদর অভিবাদন জানালেন- মারহাবা, নেককার পুত্র ও নেককার নবী। হযরত আদম আ. নবীজীর জন্য দুআ করলেন।
এরপর একে একে তিনি সাত আসমান অতিক্রম করলেন। দ্বিতীয় আসমানে দুই খালাত ভাই হযরত ঈসা আ. ও হযরত ইয়াহইয়া আ.-এর সাথে সাক্ষাত হল। তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আ.। চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রীস আ. পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন আ. ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা আ. ও সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম আ. এর সাথে সাক্ষাত হল।
এরপর নবীজীকে নিয়ে যাওয়া হল সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেই কুল বৃক্ষের একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। যখন ওটাকে আল্লাহর বিধান আচ্ছন্ন করে নিল তা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সৃষ্টির কারো সাধ্য নেই তার সৌন্দর্যের বিবরণ দেবার। জিবরাঈল বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা।
এরপর আল্লাহ তা’আলা নবীজীর প্রতি যে ওহী পাঠানোর পাঠালেন। দিনরাতে উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিলেন। নবীজী আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাতের এ হাদিয়া নিয়ে ফেরত আসছিলেন; এর মধ্যে দেখা হযরত মূসা আ.-এর সাথে। হযরত মূসা আ. জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ আপনার উম্মতের জন্য কী দিয়েছেন? নবীজী বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। হযরত মূসা বললেন, আপনার উম্মত রাত-দিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবে না। আপনার আগে আমি উম্মত চালিয়ে এসেছি। আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে কমিয়ে আনেন। নবীজী সে মতে আল্লাহর কাছে গিয়ে কম করে দেওয়ার দরখাস্ত করলেন। পাঁচ ওয়াক্ত করে করে কমিয়ে দিয়ে শেষবার আল্লাহ বলেন, হে মুহাম্মদ! এই হল দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। প্রত্যেক নামাযের বিনিময়ে দশ নামাযের সাওয়াব। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব পাবে। কেউ কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করবে কিন্তু করতে পারবে না, তার জন্যও নেকী রয়েছে। এক নেকী। আর যদি ভালো কাজটি করে তাহলে তার জন্য দশ নেকী। আর কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে কোনো গুনাহ লেখা হবে না। তবে তা করে বসলে একটি গুনাহ লেখা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬২, ১৬৪
এরপর নবী করীম ﷺ যথারীতি সাত আসমান পারি দিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস এসে পৌঁছান। সেখান থেকে বুরাকে আরোহন করে সকাল হওয়ার পূর্বেই মক্কায় মুয়াজ্জমায় এসে পৌঁছে যান।
মিরাজের ঘটনা এবং আমাদের করণীয়
মিরাজের ঘটনা নবী কারীম ﷺ এর পবিত্র সীরাতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিটি মুমিনের ঈমান ও আবেগ জড়িয়ে আছে এর সাথে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের মৌলিক কিছু বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে, মেরাজের ব্যাপারে সহীহ আকীদা পোষণ করা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে এক রাতে সশরীরে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সাত আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত, জাহান্নাম ভ্রমণ করিয়েছেন; আল্লাহ তাআলা স্বীয় বড় বড় কিছু কুদরত প্রিয় হাবীবকে দেখাবেন বলে। এটা সীরাতে রাসূলের একটি বড় অধ্যায় এবং নবী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুজিযা। এটা মুসলমানের অকাট্য মৌলিক আকীদার অংশ। অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় তা স্বীকৃত ও সুসাব্যস্ত। তাই এক্ষেত্রে স্বচ্ছ বিশ্বাস রাখা জরুরি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই ঘটনা থেকে উত্তম শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।
খুলনা গেজেট/ বিএমএস