খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে ৩ শিক্ষার্থী নিহত
  ঝিনাইদহে ২ ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাক চালকের মৃত্যু
পুঁজি সংকট, খাবার ও বাচ্চার দাম বৃদ্ধি

লোকসানে বন্ধ হচ্ছে মুরগীর খামার, প্রাণিজ প্রোটিনে অশনি সংকেত

তরিকুল ইসলাম

খাবার, বাচ্চা, ভ্যাকসিনসহ ওষুধের দাম বৃদ্ধি, পুঁজি সংকট, করোনার ধাক্কাসহ নানাবিধ কারণে খুলনার ক্ষুদ্র ও মাঝারী মুরগীর খামারিরা আগ্রহ হারাচ্ছে। লোকসানে পুঁজি হারিয়ে অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছে মুরগী পালন।

এদিকে, অধিকাংশ উপজেলা পর্যায়ের অফিসে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারিদের কোন তালিকা নেই। বিগত দু’বছরে উপজেলা পর্যায়ে মুরগী পালনের ওপর কোথাও কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এমনকি রোগ নিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণ, উদ্বুদ্ধকরণ তথা খামারিদের উন্নয়নে নেই কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ। তবে কয়েকটি উপজেলায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

কয়রার পশ্চিম দেয়াড়া গ্রামের ব্রয়লার মুরগীর খামারি আজমল হোসেন বলেন, এক বছরের ব্যবধানে ২১০০ টাকার খাবার এখন ৩৬০০ টাকা। একমাস শ্রম দেওয়ার পরেও পারিশ্রমিক উঠছে না। খাবার ও বাচ্চার দাম বাড়লেও মুরগী বিক্রিতে দাম পাচ্ছিনা। তিনি জানান, সম্প্রতি চারশ’ ব্রয়লারের বাচ্চা তোলার পরে উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে যেয়ে ভ্যাকসিন কিনতে গেলে জানানো হয় ডিসেম্বরের আগে কোন ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না। এর আগেও একবার ৬০০ বাচ্চার জন্য রাণীক্ষেত ও গাম্বুরার ভ্যাকসিন কিনতে গেলে সংকট দেখিয়ে দেয়া হয়নি তাকে।

একই গ্রামের মিলন বলেন, গত মাসে একশত পিস ব্রয়লার মুরগীর বাচ্চা উঠাই। পাইকারি মূল্য আরও কমে যাওয়ায় মাইকিং করে ১৩০ টাকা দরে মঙ্গলবারে (২২ নভেম্বর) বিক্রি করে দিয়েছি। নিজেরা পরিশ্রম করি, শ্রমিক খরচ লাগে না। তারপরেও মূলধন তুলতে হিমসিম খাচ্ছি।

এক কিলোমিটার দূরের ইসমাঈল হোসেন জানান, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ৪/৫ মাস আগে একশ পিস সোনালী মুরগী তুলেছিলাম। ২/৩ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। সেটা দিয়ে সংসার চলে না। পরে দিনমজুরীর কাজে অন্য জেলায় চলে যাই। ফলে আর বাচ্চা তোলা হয়নি। পুঁজি পেলে বড় আকারে করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।

মরিয়াম নামের এক বিধবা জানান, পুঁজির সংকটে একশ পিস করে ব্রয়লারের বাচ্চা পালন করি। আগে ভালো লাভ থাকলেও এখন তেমন কিছু থাকেনা।

বটিয়াঘাটা উপজেলার লেয়ার মুরগী খামারী মিজানুর রহমান জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে খামার করি। এক হাজার লেয়ার মুরগী পালন করি। এক চালানে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করেছি। তবে এখন খাবার ও বাচ্চার দাম বেশি হওয়ায় তেমন লাভ হচ্ছে না।

রূপসা উপজেলার কিসমত খুলনা গ্রামের বেবি খাতুন জানান, তিনি প্রায় দু’যুগ ধরে কমবেশি মুরগী পালন করেন। গেল বছর ৬০০ লেয়ার ও ২ হাজার সোনালী তোলেন। লেয়ারের বয়স দু’মাস হওয়ার পরে হঠাৎ একদিনে অর্ধেক মুরগী মারা যায়। পরের দিন বাকি মুরগীও মারা যায়। তখন খামারে ১৫ দিন বয়সী ২ হাজার সোনালী মুরগী ছিল। ১৫ দিন যেতে না যেতেই সেগুলোও মরা শুরু করে। তার অধিকাংশ মুরগী মারা যায়। সমিতি থেকে ঋণ করে খামারে মুরগী তোলায় আজও সেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ। খামারের লাভের অংশ দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। বড় ক্ষতি হয়ে গেলেও কোন সহযোগিতা মেলেনি। পুঁজির অভাবে ব্যবসা বন্ধ রয়েছে।

ডুমুরিয়ার সুবাস চন্দ্র বসু ৭ বছর ব্রয়লারের খামার করেছেন। সর্বশেষ গেল বছর সাড়ে ৩ হাজার ব্রয়লার মুরগী তোলেন। হঠাৎ মুরগীর দাম কমে যাওয়ায় বড় ধরণের ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। এখন তার খামার বন্ধ। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকে এক চালানে কিছু লাভ হলে অন্য চালানে লোকসান হয়।

খুলনা নগরীর নিরালা এলাকার জিসান নেওয়াজ। লেয়ার মুরগী পালন করতেন তিনি। দীর্ঘ সময় এ পেশার সাথে জড়িত। সর্বশেষ গেল বছর ২২০০ লেয়ার পালন করে লোকসানের স্বীকার হন। তবে পুঁজিঁ পেলে ফের খামার চালু করবেন বলে জানান তিনি।

ওপরের কেউই স্বল্প সুদে ব্যাংক লোন পাননি। তাদের কেউই উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিস থেকে কোন প্রশিক্ষণ পাননি। এছাড়া ন্যূনতম কোন ধরণের সরকারি সহায়তাও মেলেনি তাদের। সুদমুক্ত ঋণ ও উৎপাদন খরচের সাথে সমন্বয় করে বাজার মূল্য নির্ধারণের দাবি তাদের।

রূপসা, কয়রা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, দিঘলিয়ার প্রায় অর্ধশত খামারি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি দপ্তর থেকে কোন খোঁজ নেয়া হয় না। নামমাত্র সুদে ব্যাংক থেকে লোন দেয়া হয় এটার বিষয়েও অধিকাংশই জানেন না । কেউ কেউ ব্যাংকে যোগাযোগ করেও নানা জটিলতায় ঋণ পাচ্ছেন না। সমিতি থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে খামার করছেন তারা। উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও মুরগীর দাম প্রায় একই রকম থাকায় লাভ পাচ্ছেন না। ফলে তারা এ পেশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে স্বল্প পরিসরে বাচ্চা লালন পালন করছেন। কেউ কেউ ৪/৫ মাস পরে এক চালান তুলছেন।

জেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলায় তালিকাভুক্ত লেয়ার খামার রয়েছে ৯৮৭টি ও ব্রয়লার খামার রয়েছে ১৯২৭টি। আর নিবন্ধনকৃত রয়েছে ৩৭ টি লেয়ার ও ৪০টি ব্রয়লার খামার। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত চার শতাধিক মুরগীর খামার বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তালিকাভুক্ত খামারির বাইরেও বহু খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়।

আরও জানা যায়, সহস্রাধিক খামারি নিয়মিত বাচ্চা পালন করছেন না। টিকিয়ে রাখতে মাঝেমধ্যে বাচ্চা উঠাচ্ছেন তারা।

কয়রা উপজেলার উপ-সহকারি প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা সুধাংশু কুমার মন্ডল বলেন, ভ্যাকসিন সংকট থাকায় সকলকে দিতে পারিনা। করোনাকালে অন্তত ২৫ টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া কিছু খামারি অনিয়মিত মুরগী পালন করছেন।

কয়রা উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, বিগত দু’বছরে মুরগী পালনের ওপর আমাদের পক্ষ থেকে কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ কিছু খামারিকে প্রণোদনা দেয়া ছাড়া খামারিদের উদ্বুদ্ধ করতে কোন কার্যক্রম চালু নেই, তবে অফিসে আসলে পরমার্শ দেয়া হয়।

খুলনা পোল্ট্রি ফিস ফিড শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম সোহরাব হোসেন বলেন, এখন প্রতি কেজি ব্রয়লার উৎপাদনে ১৩০ টাকা খরচ হলেও মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১১৮টাকা। ক্রমাগত লোকসানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পোলট্রি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। খামারি হারিয়ে গেলে প্রাণিজ আমিষের উৎস্য কমবে। এছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষ।

তিনি আরও বলেন, বহুজাতিক কোম্পানী ও বাণিজ্যিক খামারিদের একটা কলাকৌশল রয়েছে। একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা চায় যেন প্রান্তিক খামারিরা বাজারে টিকতে না পারে। সরকার নজর দেয়না এবং সরকারি দপ্তরগুলোও উদাসীন। খামারিদের টিকিয়ে রাখতে অনেক উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অরুণ কান্তি মন্ডল বলেন, আমরা ভ্যাকসিন সরবরাহ করে থাকি। ঋণ পেতে ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে দেই। প্রচার-প্রচারণা, পরামর্শ ও চিকিৎসা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এছাড়া করোনার সময় খামারিদের কিছু টাকাও দেয়া হয়েছিল।

দর দামের বিষয়ে তিনি বলেন, মধ্যসত্ত্বভোগীরা লাভ খেয়ে ফেলছে। এই সমস্যা নিরসনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, আমরাও চেষ্টায় আছি। কলেরা ছাড়া আর কোন ভ্যাকসিনের সংকট নেই বলে তিনি জানান।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!