একাত্তরের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূ-খন্ডের ১৭ জেলায় থমথমে অবস্থা। খুলনায় তিন মার্চ টিএন্ডটি ভবন থেকে বেলুচ পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে ছাত্র জনতার মিছিলে অংশ নেয়া সাত জন নিহত হয়। একই দিন বিকেলে হাদিস পার্কে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সার্কিট হাউজের সেনা ছাউনী থেকে কনভয় শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে টহল দিতে থাকে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা টেলিফোনে ঢাকার কর্মসূচির মুখাপেক্ষি হয়ে পড়ে। হাদিস পার্কে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ পরদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ। বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে বিএল কলেজ। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের কোলাহল নেই। অফিস-আদালত বন্ধ। বড় বাজার ও হাদিস পার্ক সংলগ্ন এলাকায় কালো পতাকা উড়ছে। খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা লাঠি হাতে মিছিল করছে। খুলনার সর্বত্র ছাত্র-জনতা প্রতিদিন মিছিল করছে। মিছিলের সোচ্চার কণ্ঠে শ্লোগান ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান শেখ আব্দুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে আ ব ম নুরুল আলম, নুরুল ইসলাম খোকন, ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, নগর ভবন ও স্টেট ব্যাংকের দেয়ালে শ্লোগান লেখে ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আগ থেকে স্বাধীনতা প্রত্যাশিরা সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও মুজিব বাহিনীর জেলার ডেপুটি কমান্ডার পাবলার ইউনুস আলী ইনু স্বপ্ন সারথী নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সাত মার্চের আগেই তিনি ঢাকায় পৌঁছান। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। যুবলীগ নেতা পরবর্তীতে খুলনা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান জাহিদ ও তিনি ঢাকা বকশী বাজারের একটি হোটেলে অবস্থান করেন।
তিনি এ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, সাত মার্চ দুপুর ১২টা নাগাদ ঢাকা শহরের সকল হোটেল-রেস্তোরা বন্ধ হয়ে যায়। লাঠি হাতে হাজার-হাজার মানুষ রাজপথে নামে। নানা শ্লোগান দিতে-দিতে রেসকোর্স ময়দানের দিকে জন¯্রােত নামে। রেসকোর্স ময়দানে লাখ জনতা সমবেত হয়। বিকেল ৪টা নাগাদ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসভা স্থলে হাজির হন।
তিনি প্রবন্ধে বলেন, রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি বকশী বাজার থেকে। রোকেয়া হলের কাছে এসে পৌঁছালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বর্জ্র কণ্ঠ শুনতে পাই। সামনে আর এগোনো সম্ভব হচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন, ভায়েরা আমার …। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক এ ভাষণ শোনেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন।
ইউনুস আলী ইনু প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেন, সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ। নয় মার্চ ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মানসিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছি। সতীর্থদের সাথে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনা চলছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদ সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ, জাতীয় সংসদ সদস্য সালাহ্উদ্দীন ইউসুফ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এ্যাড. মোমিন উদ্দিন আহমেদ, এ্যাড, এনায়েত আলি প্রমুখ আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তেইশ মার্চ সরকারি বিএল কলেজ চত্বরে হাজার-হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ইউনুস আলী ইনু। পঁচিশ মার্চ পাকবাহিনী খুলনার বিভিন্নস্থানে গণহত্যা চালায়। তিনি এ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনু ২০২০ সালে ইন্তেকাল করেন।
খুলনা গেজেট/এনএম