কচুড়ি ফুল। এর নেই কোন ঘ্রাণ। ফুল তুলে প্রিয়জনকেও দেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি টব বা ফুলদানিতে সাজানোর ও নেই কোন সুযোগ। তাই বলে হাজার হাজার ফুল একসাথে ফুটে থাকলে সে দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানোর সুযোগ নেই প্রকৃতি ও ফুল প্রেমিদের। ঠিক তেমনি রূপসায় কচুড়ির ফুলের অপরুপ নান্দনিক দৃশ্য বিমোহিত করছে পথচারীদের।
পূর্ব রূপসার অচিনতলা নামে পরিচিত স্থানে গড়ে ওঠা মাদরাসার সংলগ্ন পুকুরের পানিতে ফুটে থাকা এই কচুড়ি ফুল আকৃষ্ট করছে পথচারীদের।
কচুড়ি গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত নাম। এর ফুলে ঘ্রাণ না থাকলেও দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সাধারনত শীত মৌসুমে এই ফুল বেশি ফুটে থাকে। সাদা পাপড়ির মাঝে বেগুনী রঙের ছোয়া, যেন হাতছানি দেয়। দেখলেই মন ভরে যায়। তাই প্রকৃতি প্রেমিদের কাছে এই কচুড়ি ফুল খুবই প্রিয়। অনেকেরই গ্রাম-বাংলার এই সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় না। প্রকৃতির রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে দেয় এই ফুল।
॥ কচুরিপানার সেকাল-একাল ॥
শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষার্ধে জনৈক পর্যটক কচুরিপানার অর্কিড সদৃশ ফুলে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল থেকে এ উদ্ভিদ এদেশে আনেন। বাংলাদেশে এটি এত দ্রুত ছড়াতে থাকে। ১৯২০ দশকের মধ্যেই দেশের সবগুলি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। এতে নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং নিচু জমিতে আমন জাতীয় জলিধান ও পাট চাষ কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে বাংলার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়।
এমতাবস্থায় সরকার বেঙ্গল জলপথ বিধি, বেঙ্গল পৌরসভা বিধি, বেঙ্গল স্থানীয় সরকার বিধি, বেঙ্গল গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন বিধির সহায়তায় এ দুর্যোগ মোকাবিলার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৩৬ সালে কার্যকর কচুরিপানা বিধি মোতাবেক সকলের জন্য তাদের নিজ জমি বা দখলি এলাকায় কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং কচুরিপানা উৎখাত অভিযানে সকলের সহায়তা বাধ্যতামূলক করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলিতে প্রশাসকদের সেখানকার কচুরিপানা ধ্বংস কর্মসূচি পালন এবং প্রধানত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেও কচুরিপানা উৎখাতের অঙ্গীকার স্থান পায়। ফলে ১৯৩৭ সালে এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচি জোরদার হয়ে ওঠে।
১৯৪৭ সাল নাগাদ কচুরিপানার সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরের দশকে দেশের অনেক নদীনালা আবার নাব্য হয়ে ওঠে।
এই কচুরিপানা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হলেও অনেক গুন রয়েছে। স্তুপীকৃত ও পচা কচুরিপানা ফসলের জন্য একটি চমৎকার সার। এর স্তুপ ঠিকঠাক করে তাতে নানা শাকসবজিও ফলানো যায়। ফলে ভূমিহীন চাষীরা পানিতে ভাসমান কচুরিপানার স্তুপগুলিকে কৃষি কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। জলামগ্ন এলাকায় এই কচুড়িপানার স্তুপের সাহায্যে অনেকে ভাসমান সবজির চাষও করছে।
মাছ চাষেও রয়েছে কচুরিপানার ব্যবহার। গরমে পানি শীতল থাকায় মাছ কচুরিপানার নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। কচুরির দাড়ির মতো শিকড়ের ভাঁজে ভাঁজে মাছ আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, কই মাছের খুব প্রিয় আবাস এই কচুরিপানা। পটোলের ক্ষেত কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেন চাষি। তাতে ফলন বাড়ে। কার্তিকে ডোবা ঘাস খেয়ে গরুর মড়ক লাগে। তখন গরুর নিরাপদ খাদ্য এই কচুরিপানা।
রাসায়নিক সারের মাধ্যমে জমির যে উর্বরশক্তি কমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সারে উৎপাদিত ফসলে মানবদেহে যে ক্ষতি হচ্ছে। সেখানে এই কচুড়ি পচিয়ে জৈব ও কম্পোষ্ট সার তৈরি করে ব্যবহার করে ভালো ফল পাচ্ছেন চাষীরা। এছাড়া বর্ষাকালে বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলে গবাদি পশুর খাদ্য যোগায়। হাওর অঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় বাঁশ দিয়ে আটকে রেখে ঢেউয়ের আঘাত থেকে ভিটে-মাটি রক্ষায় ব্যবহৃত হয় কচুড়িপানা।
খুলনা গেজেট/এ হোসেন