রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চতুর্থ সপ্তাহে পড়েছে। এ সময়ে অধিকাংশ অঞ্চলই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে ইউক্রেন। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে তীব্র লড়াই চলছে। রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে রাজধানী কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
স্থল, সাগর ও আকাশপথে গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশে এমন বড় হামলার ঘটনা আগে ঘটেনি। প্রাথমিক যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বলছিল, কিয়েভে ইউক্রেন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই এই অভিযান।
দুই সপ্তাহের বেশি সময়ের যুদ্ধে রুশ বাহিনী এ পর্যন্ত ইউক্রেনের কেবল একটি শহরই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় নিপার নদীবন্দর খেরসন এখন রাশিয়ার দখলে। রয়টার্সের খবর বলছে, রুশ হামলায় ভলনোভাখা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
রোববার (১৩ মার্চ) ন্যাটো সদস্য পোল্যান্ডের সীমান্তে ইউক্রেনের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটো সীমান্তে চলে গেছে। এরপর বৃহস্পতিবার পোল্যান্ডে ‘দ্য স্কাই সেভর’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। পোল্যান্ডের আকাশসীমা রক্ষায় পাঠানো হচ্ছে এই অত্যাধুনিক অস্ত্র।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাইরের দেশ থেকে আসা অস্ত্রের বড় একটি সরবরাহ তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এতে ১৮০ জন বিদেশি ভাড়াটে খুনি নিহত হয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ন্যাটো ভূখণ্ডে যে কোনো হামলার পরিপূর্ণ জবাব দেওয়া হবে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইয়াভোরিভে হামলায় দীর্ঘ-পাল্লার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় সক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু বানানোর কৌশল থেকে এখন সময় নিয়ে স্থল হামলার জোর দিয়েছে মস্কো। রুশ সাঁজোয়া যানের বহর কোথাও কোথাও দীর্ঘ সময় থমকে যেতে দেখা গেছে।
বর্তমানে ইউক্রেনের বড় বড় শহরগুলোকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়ার বাহিনী। রকেট আর্টিলারি ব্যবহার করে বোমাবর্ষণ ও গুচ্ছবোমাও মারছে। কখনো-কখনো এসব বোমা গিয়ে আবাসিক ভবন ও বেসামরিক স্থাপনায় গিয়ে পড়েছে। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে মস্কো।
রাশিয়ার দাবি, প্রতিবেশী দেশকে তারা নিরস্ত্রীকরণ করতে চান। সেখানকার উগ্র-জাতীয়তাবাদী নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউক্রেন ও পশ্চিমা মিত্ররা বলছে, বিনা উসকানিতে রাশিয়ার এই হামলায় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছেন।
নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
অভিযানের শুরুর মুহূর্তগুলোতে ব্যাপকহারে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছিল। এছাড়া সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় সক্ষম স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এসআরবিএমএস) ব্যবহার করা হয়েছে প্রথম দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে, রাশিয়ার প্রথম হামলায় স্থল ও সাগর থেকে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) গবেষণা বিশ্লেষক টিমথি রাইট বলেন, রাশিয়া সম্ভবত কেবল যুদ্ধে নিয়োজিত এসআরবিএম ও ইসকানদার-এম ব্যবহার করেছে। তাদের বিপরীতে অনেক পুরনো দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দ্য ওটিআর-২১ টোকখার সীমিত সরবরাহ আছে ইউক্রেনের। যুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলোতে রুশ ভূখণ্ডের মধ্যে বিমান ঘাঁটিতে এ রকম অন্তত একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে।
আইআইএসএসের তথ্যানুসারে, টোকখার চেয়ে ইসকানদার-এম অনেক বেশি পাল্লার। এছাড়া এটির উৎক্ষেপক থেকে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া সম্ভব। ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রতিটি ইসকানদারের একটি করে সাঁজোয়া ঢাকনা থাকে। রাসায়নিক, জৈব, তেজস্ক্রিয় ও পারমাণবিক ঝুঁকি থেকে এটির ক্যাবিন অনেক নিরাপদ। প্রচণ্ড তাপমাত্রাও ক্যাবিনের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। যানটি এবড়োখেবড়ো সড়ক দিয়েও ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগে এক হাজার ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
ইসকানদার-এমের পাঁচ থেকে সাত মিটারের সার্কুলার ইরর প্রবাবল (সিইপি) আছে। এর অর্থ হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্রের অর্ধেকটা গোলা তার বৃত্তের সমান ব্যাসার্ধ নিয়েই আঘাত হানবে। সেই তুলনায় তোকখার সিইপি ৯০ মিটার।
২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের সামরিক কমান্ড জানিয়েছে, সুমি, পোলতাভা ও মারিউপুল শহরের কাছাকাছি বিভিন্ন এলাকায় ৩এম১৪ ক্যালিবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে। কৃষ্ণসাগর থেকে ছোড়া হয়েছে এসব প্রজেক্টাইল। ক্যালিবর স্থল হামলার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র (এলএসিএম), যার পাল্লা দেড় থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার হবে। এটির সঠিক সিইপি জানা সম্ভব না হলেও পাঁচ মিটারের কম হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আইআইএসএসের প্রতিরক্ষা গবেষক জোসেফ ডেম্পসি বলেন, বিমান ঘাঁটিতে রাশিয়ার হামলা তুলনামূলক সীমিত বলেই মনে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আঘাত হানতে পারেনি তারা। যুদ্ধ পরিচালনার বিমানের বদলে স্টোরগুলোতে হামলা করা হয়েছে।
ঠাণ্ডাযুদ্ধকালীন রাশিয়ার-নির্মিত এস-৩০০ভি বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা আছে ইউক্রেনের হাতে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতাও আছে এটির। এগুলো কোনো রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে কিনা, তা এখনো জানা যায়নি। তবে হামলা চালিয়ে এস-৩০০ভি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
হামলার প্রাথমিক দিনগুলোতে কিয়েভ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ মস্কো। এতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার আকাশ সক্ষমতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এখনো সচল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকেরাও ধাঁধায় পড়ে গেছেন।
সময় নিয়ে স্থল হামলা
পূর্ব ও উত্তরের প্রধান দুটি সম্মুখসারিতে রাশিয়ার উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। বৃষ্টির মতো বোমা হামলার মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে দুই বড় শহর কিয়েভ ও কারকিভ। রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে চাওয়া ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিচ্ছে সাধারণ নাগরিকেরা। দেশজুড়ে বেসামরিক প্রতিরক্ষা ইউনিট ও স্বাধীন মিলিশিয়া গোষ্ঠী গঠন করা হয়েছে।
রুশ বাহিনীর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শহুরে গেরিলারা। নাগরিক পরিবেশের মধ্যেই তারা অপ্রচলিত যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছেন। ভবন, গাছপালা ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এসব গেরিলা লুকিয়ে থাকেন। ইউক্রেনের সেনারাও একই কৌশল বেছে নিয়েছেন। সড়ক চিহ্ন তুলে দিতে নাগরিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে শহরের রাস্তাঘাটের সঙ্গে পরিচিত হওয়া রুশ সেনাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
রুশ সাঁজোয়া যানের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে কীভাবে মলোটভ ককটেল ছোড়া হবে, সেই নির্দেশনা সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে ইউক্রেনের সরকার। এছাড়া ট্যাংকবিধ্বংসী ব্যারিকেড তৈরি করছেন ইউক্রেনে নাগরিকেরা। যার প্রতীকী নাম দেওয়া হয়েছে ‘সজারু’। এসব ব্যারিকেডের ছোট সুঁচালো মাথার কারণে চাকায় চলা যানবাহন থেমে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যুদ্ধট্যাংকসহ পদাতিক যুদ্ধযানও রয়েছে ইউক্রেনের।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, রাশিয়ার বাহিনী ক্রমাগত হতাশ হয়ে পড়ছে। ইউক্রেনের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার জন্য যা খুবই জরুরি। যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মতে, এই অভিযানের জন্য রাশিয়ার তার সর্বশক্তি বরাদ্দ রেখেছে।
ইউক্রেনকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে সাঁজোয়া যান গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে। শহরের ভেতরে যুদ্ধে এসব অস্ত্র খুবই কার্যকর—নিজেকে লুকিয়ে রেখে শত্রুর ওপর অতর্কিত হামলা করা যায় যা দিয়ে।
ভয়াবহ এ অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে এনএলএডব্লিউ ও ১৪৮ জ্যাভেলিন। পরবর্তী প্রজন্মের ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এনএলএডব্লিউ যৌথভাবে ব্রিটেন ও সুইডেন নির্মাণ করেছে। আর হালকা ওজনের জ্যাভেলিন যুক্তরাষ্ট্রের-নির্মিত। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে এই অস্ত্র দিয়ে ট্যাংক ধ্বংস করে দেওয়া যায়।
ইউক্রেনের কাছ থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, ট্যাংকসহ রাশিয়ার সামরিক যান পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিয়েভ বাহিনীর প্রতিরোধ ছাড়াও রুশ সাঁজোয়া যানের কারিগরি ও প্রক্রিয়াগত ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী সম্পর্কে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এমন আয়তন ও জটিলতার মধ্যে অন্য দেশে ঢুকে যাওয়ার খুব বেশি অভিজ্ঞতা তাদের নেই।
কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে কোনো ব্যর্থতা আছে কিনা, তা পরিষ্কার না। কিন্তু রুশ বাহিনী যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে সম্ভবত পরিবর্তন আসবে কিংবা খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে তারা।
এ লড়াইয়ে ইউক্রেনের হাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার আছে। সেটি হচ্ছে তুরস্কের নির্মিত মানববিহীন আকাশযান বায়রাকতার টিবি২। এই ড্রোনে সাঁজোয়া যানবিধ্বংসী ছোট ছোট অস্ত্র থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের বাহিনীকে যা ব্যাপক সফলতা এনে দিয়েছে। আংকারায় ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিল বোদনার বলেন, এই ড্রোন খুবই কার্যকর ও দক্ষ।
সামাজিকমাধ্যমে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, রাশিয়ার সামরিক বহর মাটিতে মিশিয়ে দিতে বায়রাকতার কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কয়েক দফায় কিয়েভের কাছে টিবি২ ড্রোন বিক্রি করেছে তুরস্ক। পূর্ব ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেও এই ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
টিবি২ ড্রোনে থাকা সাঁজোয়া যান বিধ্বংসী অস্ত্র অনেকটা ন্যাম-এলের মতো। এতে অতি ক্ষুদ্র গোলাবারুদ থাকে। এটি তার লক্ষ্যবস্তুতে ফেলা লেসার রশ্মীকে অনুসরণ করে এবং আঘাত হানার আগে আট কিলোমিটার পর্যন্ত ভেসে বেড়াতে পারে।
ড্রোনটির উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বলছে, এটি ২২ কেজি ওজনের বোমা বহন করতে পারে এবং হালকা আঘাতেই সাঁজোয়া যান ধ্বংস করে দিতে পারে।
অবরোধ কৌশল
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন এনেছে রাশিয়া: সরাসরি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা না-চালিয়ে শহর অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গেল সপ্তাহে বোমা হামলার আগে কিয়েভের নাগরিকদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেছে তারা। কারকিভে বৃষ্টির মতো রকেট ছুড়েছে। মানুষের বাড়িঘর থেকে শুরু করে বেসামরিক স্থাপনাগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।
কারকিভ অঞ্চলের প্রধান ওলেগ সিনেগুভব বলেন, ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহৎ শহরের কেন্দ্রস্থলে হামলা চালিয়েছে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। আবাসিক এলাকাসহ আঞ্চলিক প্রশাসনের ভবনগুলোও তারা ধ্বংস করে দিয়েছে।
মারিউপল শহর কর্তৃপক্ষ বলছে, দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় ইউক্রেনের বন্দরে ইচ্ছা করে বেসামরিক স্থাপনায় নির্বিচারে গোলা ছুড়ছে রুশ বাহিনী। এতে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রসদ সরবরাহ কিংবা লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সাধারণত শত্রুর অবস্থানকে ঘেরাও রেখে তাকে দুর্বল করতে যুদ্ধে অবরোধ কৌশল ব্যবহার হয়ে আসছে। এতে রসদ সরবরাহ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এমন ব্যবস্থা করা হয়, যাতে শত্রুরা পালাতে না পারেন। অবরুদ্ধ থেকে দুর্বল হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। এতে সাঁজোয়া যানের বহর যেমন থাকে, তেমনি স্থলবাহিনীর সঙ্গে প্রকৌশলীরাও অংশ নেন।
এছাড়াও রুশ সামরিক বাহিনী মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম (এমএলআরএস) ব্যবহার করছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে বিএম-২১। এতে ১৮টি লঞ্চারের একটি ব্যাটালিয়ান একসঙ্গে ৭২১টি রকেট ছুড়তে পারে। এসব রকেট গাইডেড না-হওয়ায় তা এলোপাতাড়ি গিয়ে আঘাত হানে। সাধারণ কামানের মতো এগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে পড়ে না। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে গেলে এটি ব্যবহার করা যাবে না। কোথাও একই সঙ্গে অনেকগুলো রকেট হামলা চালাতে হলে বিএম-২১ ব্যবহার করা যাবে।
ইউক্রেনে রাশিয়াকে থার্মোবারিক বা ভ্যাকিউম বোমা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এই বোমার ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে পশ্চিমারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জ্বালানির মিশ্রনের একটি মেঘ ছত্রভঙ্গ করে দেয় থার্মোবারিক। পরে তাতে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। উচ্চ-তাপমাত্রার বিস্ফোরণ ঘটাতে পার্শ্ববর্তী বাতাস থেকে অক্সিজেন ব্যবহার করে এটি। এর মধ্যে ফুয়েল-এয়ার বিস্ফোরক হল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালিস বলেন, আমরা থার্মোবারিক অস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করতে দেখেছি। এর ব্যাপক ব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
রাশিয়ার আরেকটি অস্ত্র হচ্ছে টিওএস-১ বুরাটিনো। ভারী অগ্নিনিক্ষেপক এই ব্যবস্থা হচ্ছে একটি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার। ট্যাংকের শ্যাসি বা অবকাঠামোর ওপর এটি বসানো থাকে। এতে গোলাবর্ষণে থার্মোবারিক ওয়ারহেডের সঙ্গে আনগাইডেড আর্টিলারি রকেট ব্যবহার করা হয়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুচ্ছ বোমা ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, নিষিদ্ধ গুচ্ছ বোমার ব্যবহার করছে রাশিয়া। বেসামরিক নাগরিকদের আশ্রয় নেওয়া প্রাক-বিদ্যালয়েও হামলা করা হয়েছে।
তবে ইউক্রেন দখল করতে না, বরং প্রতিবেশী দেশের সামরিক সক্ষমতা নস্যাৎ ও বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদীদের ধরতেই এই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দাবি করছে মস্কো।
পরবর্তীতে কী ঘটতে যাচ্ছে
ইউক্রেনের বড় বড় শহরগুলো অবরোধ করে রেখেছে রুশ বাহিনী। বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে করিডোর খোলা হয়েছে। বর্তমানে রুশ-ইউক্রেনের আলোচনার মূল আলোচ্যবিষয়, অবরুদ্ধ এলাকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সুযোগ দেওয়া।
মারিউপুলে মানবিক করিডোরে রাশিয়া গোলাবর্ষণ করছে বলে অভিযোগ ইউক্রেনের। শহরগুলোতে ইতিমধ্যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পূর্বাঞ্চলীয় শহর সুমি থেকেও নাগরিকদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে পোল্যান্ড বলছে, তাদের সব এমআইজি-২৯ যুদ্ধবিমান জার্মানির র্যামস্টেইন বিমানঘাঁটিতে মোতায়েনে তারা প্রস্তুত আছে। এগুলোকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিতে চায়। অন্য ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে একই পথ অনুসরণের অনুরোধ করেছে দেশটি। এসব বিমান ইউক্রেনে পাঠাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছে কংগ্রেসের আইনপ্রণেতারা। যদিও তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
পেন্টাগন বলছে, ন্যাটো ভূখণ্ড থেকে যুদ্ধাঞ্চলে যুদ্ধবিমান পাঠালে পুরো জোটের জন্য তা উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। ইউক্রেনকে এই বিমান দেওয়া হলে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই তা চালাতে হবে পাইলটদের। এতে ঝুঁকি বাড়বে।
ইউক্রেনে উড়াল-নিষিদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করতে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় পশ্চিমা দেশগুলোত তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
খুলনা গেজেট/কেএ