অধ্যাপিকা মাজেদা হক সু-লেখিকা, সফল সংগঠক, সর্বপরি একজন সহজ সরল মানুষ। তাঁর বড় মেয়ে নাহিদ আমার সহপাঠী। ১৯৭৭ সালে ফাতিমা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমরা একসাথে এসএসসি পাশ করি। সেই সুবাদে মাজেদা হক আমার খালাম্মা। স্কুলের কাছেই নাহিদ-দের বাড়ি থাকায় ছোটবেলা থেকেই খালাম্মার সান্নিধ্যে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। পরবর্তীতে সাহিত্য -সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর সঙ্গে আমি গ্রন্থিত হই।
মূলতঃ লেখিকা সংঘেই আমরা খুলনার লেখিকারা মাজেদা আলী আপার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে লেখার চর্চা ও প্রসারে এক সময় কাজ করতাম। অবশ্য সাহিত্য পরিষদ, কবিতালাপ, সাহিত্য মজলিশ সহ অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনেও খালাম্মার সঙ্গে সাহিত্য আন্দোলনে দেখা হতো।
পরবর্তীতে ২০০১সালে রেহেনা আক্তার আলেয়া আপার মাধ্যমে মাজেদা হক কে সভানেত্রী করে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, খুলনা গঠিত হলে তাঁর সঙ্গে ক্রমশ আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রূপসা নন্দিনীতে এক বছর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর একটানা দশ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। খালাম্মার সভানেত্রীত্বে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারি তিনি সত্যিই একজন প্রাণখোলা, সাহিত্য রসে ভরপুর এবং সাংগঠনিক তৎপরতায় অত্যন্ত আন্তরিক একজন মানুষ, সর্বপরি একজন বলিষ্ঠ সংগঠক। একদিকে তিনি যেমন সরল-সহজ অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা একনিষ্ঠ মানুষ, যার কারণেই রুপসা নন্দিনীর উপর সকল ঝড় ঝাপটা তিনি মাথা পেতে নিয়েছেন।
প্রবল প্রতিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বহুমুখী জটিল সমস্যার মধ্য দিয়েই রুপসা নন্দিনীকে খুলনায় প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছে। সেই কঠিন পথে মাজেদা খালাম্মার সঙ্গে স্মরণ করি, অধ্যাপিকা শাহনেওয়াজ বেগম, কথা সাহিত্যিক মন্নুজান হোসেন, প্রফেসর আনোয়ারী বেগম, লায়লা আজাদ, মেরীনা আহমেদ, পারভীন বিল্লাহ,মমতাজ রেজা মুক্তা, তাহমিনা বেগম, আশরাফুন্নেছা দুলু, অধ্যাপিকা সুরাইয়া বেগম, শামসুননাহার পারা, অধ্যাপিকা হাসিনা নাহিদ, শাহিনা বাবর, রেবা বিশ্বাস প্রমুখ।
মাজেদা হকের নেতৃত্বে এবং এই সমস্ত আপাদের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় রুপসা নন্দিনীর প্রাথমিক নাজুক পথযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে রুপসা নন্দিনীতে একঝাঁক প্রাণচঞ্চল ও উদ্দীপনাময় সাহিত্যমোদী মানুষ সংযুক্ত হয়ে এর কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার করে। তাদের মধ্যে মুর্শিদা আক্তার রনি, প্রফেসর সেলিনা বুলবুল, অ্যাড. অলকানন্দা দাস, হোসনেআরা মাহমুদ লিলি, খুর্শিদা আক্তার হেলেন, সিস্টার মেরী, শামীম আরা রিতা, রহিমা জালাল, মামনুরা জাকির খুকুমনি, বুলবুল আক্তার, সুরাইয়া পারভিন, ইয়াসিন আরা রুমা, সুলতানা হাসান দুলু, ফরিদা ইয়াসমিন রানু, জাহানারা আলী জানু, মাহমুদা হোসেন মিতা, হাসনা হেনা, নুরজাহান বেগম শেলী, তাহমিনা আক্তার খানসহ আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য তবে ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১১ সালে রুপসা নন্দিনীর জাতিসংঘ পার্কে পক্ষকালব্যাপী একুশের বইমেলায় নেতৃত্ব দেওয়ার প্রেক্ষিতে এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি হয়। সেই সময় সংগঠনের পক্ষে মুর্শিদা আক্তার রনির সক্রিয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা স্মরণযোগ্য। যা রুপসা নন্দিনীকে স্বীকৃতির উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে।
নন্দিনীদের ঘর থেকে বাইরে পা রাখতে, খুলনার বৃহত্তম অঙ্গনে কাজ করতে, খুলনার বাইরে এমনকি দেশের বাইরে যেমন, কলকাতা, আসাম, শিলিগুড়ি, দিল্লী প্রভৃতি জায়গায় সাহিত্য প্রসারে মাজেদা হক অভিভাবকত্বের বিরল দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মাথার উপর ছিলেন বলেই আমি -আমরা পরিবার থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছি। তিনি সর্বদা আমাদের সঙ্গে থেকেছেন, আগলে রেখেছেন। সকল প্রতিবন্ধকতায় অন্যান্যদের পরামর্শে আমার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। তার প্রতি রুপসা নন্দিনী যেমন আজন্ম ঋণী, তেমনি ব্যক্তিগত ভাবে আমিও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
একদিকে আমায় যেমন স্নেহ করতেন অন্যদিকে অনেক আস্থার জায়গায় স্থান দিতেন। যার কারণে তাঁর তিনটা বই ত্রি-ধারা, কপোতাক্ষের মরা বাঁকে, এবং দৃষ্টির সীমানায় আমার তন্ময় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া বহু সাহিত্যকর্মে আমি তার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলাম। সপ্তর্ষী, বনলতা, তন্ময় প্রকাশনী, লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতি প্রভৃতি সংগঠনে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। তিনি একজন নিবেদিত, নিরলস পরিশ্রমী, নিরহংকার, একনিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন। ধর্মীয় ব্যাপারেও তিনি আন্তরিক ছিলেন এবং আর্তের সেবায় এগিয়ে যেতেন। তাঁর মত সৃজনশীল ও মানব দরদী মানুষ কমই জন্মে। তাঁর শূন্যতা অপূরনীয়।
পরিশেষে খালুজান ডাঃ মোজাম্মেল হকের কথা একটু না বললেই নয়। তিনি ছিলেন খালাম্মার গাইড এবং ফিলোসফার। তিনি সর্বদা খালাম্মাকে সব কাজে এগিয়ে দিতেন। প্রত্যক্ষভাবে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের তিনি নিরব প্রহরী ছিলেন।
নন্দিনীর প্রতিষ্ঠাতা সুলতানা রিজিয়া খুলনায় এলেই কেবল তাঁদের বাড়িতেই উঠতেন। তাঁদের আতিথেয়তায় আমরা অতিথি নন্দিনীদের বহু সেবা করতে পেরেছি। খালুজান ফজরের সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে নন্দিনীদের বাড়ী নিয়ে এসেছেন। তাই খালাম্মার মত খালুজানও রুপসা নন্দিনী পরিবারের পরম বন্ধু ও অভিভাবক ছিলেন। তাঁদের দু’জনের প্রতিই গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আজ মাজেদা হক খালাম্মা ও খালুজান নেই। তাঁদের আত্মার নিরব বিচ্ছেদ আমায় বেদনার্ত করে। স্মৃতির
অশ্রুজলে ধুয়ে যায় লেখনী সামগ্রী। তবু যেমন করোনা বিধ্বস্ত পৃথিবীর আকাশে ভোরের আলো ফোটে তেমনি নব আশায় নূতন নন্দিনীদের পানে আমরা তাকাই যাদের মধ্যে নূতন উদ্দীপনা।
ঝুমু,ময়না, জেসমিন, হ্যাপি, কাজল, কাওসারী জাহান, শেলী, বেবী, কানিজ, সালমা, তিমু, শ্রাবনী, রিমা, ফরিদা, মৌসুমী, হ্যাপি আলম, আলমাস আরা, রেনাতা মিস্ত্রী, নাদিয়া মাহমুদ রাণীসহ আরও অনেকে। যাদের মাঝে বেঁচে রইবেন মাজেদা হক। আমরাও তারই প্রত্যাশায় অপেক্ষমান।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে)