দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে যায়। বাঁধের উপরই বসতি। গ্রামের মানুষগুলো আর গ্রামে ফিরে যেতে পারেনি। অধিকাংশ বাড়িঘর আর নেই। যা টিকে আছে, তাও বাস করার মতো নেই। শিবুদের বাড়ি-ঘরগুলো নেই, আসবাবপত্রও একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। সরকারের পক্ষ থেকে ঘর তৈরি করার জন্য বিশ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। বিশ হাজার টাকায় কি থাকবার মতো ঘর হয়! তাও দিয়েছে। অনেকেরই উপকার হয়েছে। কেউ কেউ তাদের বাড়ি-ঘরে গিয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় চলে গিয়েছে এদিক-ওদিক। কাজের আশায়, পরিবার টিকিয়ে রাখার আশায় সকলেই ছুটছে। নিকটবর্তী শহরে, বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের কাছে, উপজেলা সদরে, এমনকি দেশের পূব-দক্ষিণ এলাকার রাঙ্গামাটি শহরেও অনেকে গিয়েছে। আর একটি বড় অংশের মানুষ চলে গিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড রাজ্যে। তবে বেশীরভাগ মানুষ গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ওই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই যাওয়া। কোন কাজ জুটিয়ে নিয়ে পরিবার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা। উপায়হীন যারা এখানে রয়ে গিয়েছে সেই পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা ফকিরহাট, বাগেরহাটের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি গোপালগঞ্জেও কাজের জন্যে যাচ্ছে। ভাবা যায়, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ওইসব এলাকা হতে কাজের আশায় এক সময় মানুষ আসতো। তখন ধান কাটার সময়। ওই সময়ে অনেক মানুষের প্রয়োজন হতো। মানুষ আসতো। ধানের ক্ষেতের পাশে ওই মানুষগুলো নাড়া দিয়ে তাবুর মতো করে অস্থায়ী ঘর তৈরি করতো। সেখানেই তাঁরা থাকতো। ধানা কাটা, মলন দেওয়ার পর তা মালিকের ঘরে তুলে, বুঝে দিয়ে তাদের পাওনার ধান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতো। এদেরকে বলা হতো পরবাসী।
চিংড়ি চাষ প্রসারের সাথে সাথে পরবাসীদের আসা বন্ধ হয়ে যায়। ধান হয় না, পরবাসী কেন আসবে! আর বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যেই অবস্থা ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে। সুন্দরবনের কোলের মানুষদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে; আর যে এলাকা থেকে পরবাসীরা এই সুন্দরবনের কোলে আসতো, সেখানেই এখন কাজের জন্য মানুষ ছুটছে। তবে কাজের কোন ঠিক নেই। দিনমজুরির কাজ। নির্মাণ কাজের সহযোগীর কাজ, আর আছে ইটভাটির কাজ। শিবুও বেশ কয়েকবার ফকিরহাট এলাকায় গিয়েছে কাজের জন্যে। এই এলাকার অনেকেই যায়। একসঙ্গে দল বেঁধে গিয়ে বেশ কিছুদিন কাজ করে আবার ফিরে আসে। শিবুর ভালো লাগে না। দৈহিক পরিশ্রমের কাজ সে অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে করতেও পারে না। একই সঙ্গে কয়েকজন কাজ করছে, তাতে সে পিছিয়ে পড়ে। এতে সঙ্গীরাও নানা কথা বলে। কথার ডালপালা গজিয়ে তা নিয়োগ-কর্তার কানে গেলে সেও দু’চার কথা বলে। কিন্তু হাসির মুখটি তার মনে পড়ে। ওদের জন্যে কাজ করতে হবে। এটাইতো প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু শিবু খুবই কষ্ট পায়, যখন সঙ্গীরা বৌ- অনিতার কথা বলে নানান ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে। দীপকটাতো খুবই খারাপ! সেদিন বলছিল, ‘ও শিবু দা, অনিতা বৌদি যদি কারও সাথে পালায় যায়, তহোন তুমি কি এরবানে। কাজ-কামে তুমার মন নেই। ওর চেয়ে তুমি চইলে যাও, বৌদিরে পাহারা দেও।’ এতে শিবু’র বিরক্তি বাড়ে। রাগে-ক্ষোভে জ¦লতে থাকে। কিন্তু কিছুই বলে না। কি বলবে!
সমীরণ-এর আসা-যাওয়া শিবুও পছন্দ করে না। সমীরণ আসে। ইদানিং বেশ ঘন ঘন আসে। সমীরণের সাথে বৌ বেশ হেসে হেসে কথা বলে। অথচ তার সাথে শুধু মুখ ঝামটা। নানান আ-কথা-কু-কথা। আমি নাকি, অকম্মার ঢেঁকি। কোন কাজের না। কোন ক্ষমতাই নেই আমার। না পারি টাকা রোজগার করতে, না পারি কাউকে তুষ্ট করতে। বৌডারেও তুষ্ট করতি পারিনি! তুষ্ট করতি পারলি নিশ্চয়ই ও রুষ্ট হতো না। অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হতো না! দূরে থাকার লাভ ওই, বৌয়ের নিত্য গঞ্জনা হতে রেহাই পাওয়া যায়। তাই বলে, সে মেয়ে দুটোরে ফেলে চলে যাবে! মা-কি কখনও তাই পারে! আমি না হয়, তাকে সুখ দিতি পারিনি। তাই বলে, তার সন্তান দুটো ফেলে চলে যাবে! তা কি কখনও হয়। ওই সন্তান কি সে পেটে ধরেনি! তার জন্যে কষ্ট সহ্য করেনি! বড় করতে তার কষ্ট হয়নি! না, শিবু আর ভাবতে পারে না। কেমন যেন মাথাটা ভারী হয়ে আসে।
বৌয়ের উপর শিবু বড্ড নির্ভর করে। আজ পর্যন্ত কোন কিছুই সে বৌয়ের পরামর্শ ছাড়া করেনি। এতে বৌ খুশী হওয়ার চেয়ে বেজার হয়। এর কি কারণ হতে পারে, তা শিবু বোঝে না। দু’-একবার সে একান্ত দু’-একজন বন্ধুদের সাথেও কথা বলেছে। কেউ কেউ বলেছে, ’ওরে তোর বৌ তোরে খাতির করে না। বৌ-রে বশে রাখতি হলি যোগ্যতা লাগে, বুঝলি।’ কি সেই যোগ্যতা, তা সে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ বলেছে তুই ডাক্তার দেখা। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদের ঘাটতিতো একটা সমস্যা। তবে স্বামী-স্ত্রীর পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্কটি আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কি সেই কিছু, তা শিবুর মাথায় ঢোকে না। আজকাল তার ঘুরেফিরেই মনে হয়, সত্যি কি বৌ-টা তাকে ছেড়ে চলে যাবে!
এবারে ফকিরহাট আসার আগেও ঘটেছে নানান ঘটনা। অনিতা যেন তাকে সহ্য করতেই পারে না। সে যে অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে তাও না। বরাবরই কি অনিতা এমন ছিল, নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করে শিবু। না, তাতো নয়। বিয়ের পর বছর পাঁচেকতো ভালোই ছিল। তারপরই কেমন যেন হয়ে গেল! অনিতা যেন আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল। সে আর শিবুর ভালো লাগা, মন্দ লাগা, স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। তারপর আইলার পর বাঁধের উপরের জীবনগুলোয় এ যেন অক্টোপাশের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। একদিকে অভাব, অন্যদিকে অশান্তি। সব দোষ গিয়ে পড়ে ওই পাড়ার সমীরণের উপর। সে কেন এখানে আসে। সমীরণ-এর আসা-যাওয়া বেশ বেড়েছে। ছেলেটা বেশ চালাক। আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসবে। তাতে মেয়ে দুটো বেজায় খুশী হয়। আর তাদের মা-টাতোই তার আসার অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকে। শিবু’র চেয়ে বয়সে তরুণ, তাগড়াই যুবক সমীরণ। সে-কারণেই কি অনিতা তার প্রতি দুর্বল হল?
সেদিনও প্রায় সন্ধ্যের দিকে নিজেদের ঝুপড়ির মধ্যে গিয়ে শিবু বেশ অস্থির হয়ে ওঠে। বড় মেয়েটি আপেল খাচ্ছিল। তার উদ্বেগ, এই আপেল এলো কি করে! তবে কি সমীরণ এসেছিল! মিঠু একটি আপেল নিয়ে দৌড়ে বাবাকে দিয়ে বলে, ’বাবা, বাবা, আপেল খাও। শিবু তা না নিয়ে বউকে বেশ ঝাঁঝের সাথেই জানতে চায়, বউ, আপেল দিলো খিডা।’
-খিডা আবার, সমীরণ। অনিতা বেশ ঝাঁঝের সাথেই জবাব দেয়।
-ও, সে আবার আইলো বুঝি।
-হ, আইছিলো। কেন, আসলি কি হয়?
-আমি না তোরে কইছি, তারে আসতি বারণ করবি। তা তোর গায়ে লাগে না।
-কেন আমি বারণ করবো, তোমার ভালো না লাগলি, তুমি কও।
স্বামী-স্ত্রীর এই কথাকাটাকাটির মাঝেই হাসি এসে দাঁড়ায়। সে দুই ঘর পরেই ছিল। বাবা-মায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠে সে দৌড়ে ছুটে আসে। বছর দশেক বয়সী হাসি আগেও শুনেছে, বাবা-মাকে সমীরণ কাকুর কথা তুলে বকাবকি করছে। বাবা কেন যেন সমীরণ কাকুকে পছন্দ করে না। কিন্তু মা তাকে পছন্দ করে। তারও তাকে বেশ পছন্দ হয়। ভালো কথা বলে। এলে তাদের জন্যে অনেক খাবার নিয়ে আসে। তার স্কুলে যাওয়ার জন্যে বই-খাতা নিয়ে আসে। বাবার কাছে চেয়ে যা না পাওয়া যায়, সেই জিনিসের জন্যে সমীরণ কাকুই ভরসা। তার কারণেই সে আবার স্কুলে যায়। ঝড়-বাদলার সময় মাসখানেক সে স্কুলে যেতে পারেনি, তারপর স্কুলে যায়। স্কুলটি বেশ দূরে। আরও অনেকে যায়। স্কুলে গেলে তার ভালো লাগে। সেখানে গেলে রতন দাদার সাথে দেখা হয়। সে তার চার ক্লাস উপরে পড়ে। হাসি ক্লাস ফোরে, রতন এইটে। আর দুই বছর পর রতন এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আচ্ছা, এসএসসি পরীক্ষা দিলে সেতো আর এই স্কুলে আসবে না। তখন কি হবে, কি করে সে তার রতন দা’র সাথে দেখা করবে। বুকের মধ্যে কেমন যেন হু হু করে ওঠে।
বাবা-মায়ের কথার মাঝেই হাসি বলে ওঠে, তোমরা চুপ করো। ঝগড়া কইরে না। লোকজন সব আড়ালে থেকে যা নয়, তাই বলে।
শিবপদ চিৎকার করে ওঠে, ওই দেখ, ওইটুকুন মাইয়ে আইছে, মা’র সাফাই গাতি। এই তোর মারে কতি পারিস নে। ও, তুইতো দু’দিন পরে ও-ই হবি।
হাসির মন খারাপ হয়ে যায়, বাবা কিসব বলছে। আমি কি হবো। মায়ের সম্পর্কেই বা সে কি বলতে চাইছে।
তারপর শিবু পাড়ার অন্যান্যদের সাথে ফকিরহাট চলে যায়। এক নতুন ইটখোলায় কাজ করে তারা। কাজ শেষে রাতের বেলায় সকলে যখন একসঙ্গে জড়ো হয়, তখন নানা হাসি-তামাশা হয়। কেউ কেউ তাস খেলে। আগে কখনও কখনও শিবু তাস খেলতে বসতো। আজকাল তার কিছুই ভালো লাগে না। তাস খেলাতো নয়ই। একটু নিরিবিলি হলেই তার ঢাকির পাড়ের বাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছবি ভেসে ওঠে। সেই ছবির মাঝখানেই তারও একটি ঝুপড়ি ঘর আছে। সেখানে অনিতা তাদের দুটো সন্তান নিয়ে তাকে। কিন্তু আজকাল অনিতা অনেক দূরের একজন হয়ে গিয়েছে। সে আর আপন নেই। মাঝে মাঝে এও ভাবে, যদি সত্যি সত্যি অনিতা তাকে ত্যাগ করে, তা হলে মেয়ে দুটোর কি হবে? কিভাবে তাদের বড় করে তুলবে সে।
অনিতা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। তার আর এই ঘর-সংসার ভালো লাগে না। সমীরণকে তার ভালো লাগে। তার পৌরুষ আছে। খেতে দেওয়ার সামর্থ্য আছে। সে তার স্পর্শ চায়। মাঝেমাঝে তার ছোঁয়া পেতে সে যেন অস্থির হয়ে ওঠে। তার সাথে একাধিকবার কথা হয়েছে, সমীরণ তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে চায়। কোথায় সেই দূর? সমীরণ বলেছে, তাকে ভারতে নিয়ে যাবে। সেখানকার নৈহাটিতে তার পরিচিত বন্ধুরা আছে, সেখানে সে গিয়ে ব্যবসা করবে, সে ব্যবস্থা পাকা করে ফলেছে। শুধুমাত্র অনিতা রাজি হলেই হয়। হাসি ও মিঠুর কি হবে। মিঠু ছোট। বুকের দুধ খায়। তাকে রেখে কি করে যাবে।
সমীরণ বলে, না মিঠুকে নিয়ে চলো। ওকে আমরা বড় করে তুলেবো। কিন্তু হাসি। দিন দিন সে বড় হচ্ছে। মায়ের সাথে সমীরণের এই নতুন সম্পর্ক সে কি মেনে নেবে! যদি এখন মেনেও নেয়, দু’দিন পর কি তা মেনে নেবে! তখনতো আর এক অশান্তি হবে। অনেক ভেবেচিন্তে অনিতা-সমীরণ কথা বলে ঠিক করে, তাহলে মিঠুকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। আর হাসি থাকবে, তার বাবার কাছে। শিবু তার মেয়েকে বড় করে তুলবে। অবশ্য হাসি এখন সবকিছুই নিজে নিজে করতে পারে। বোঝেও। মা থেকেও তার কাছে থাকবে না। আর কোনদিন হয়তো দেখাও হবে না। কখনও কখনও আপন মনকেই, নিজেকেই সে ধিক্কার দিতে শুরু করে। এসব সে কি ভাবছে! আবার শিবুর কথা মনে উঠলেই যেন বিরক্তি তৈরি হয়। নিজেকে শক্ত করে। সমীরণের মুখটাই এখন সবসময় তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কি করবে অনিতা।
একদিন ভোরবেলায় অনিতা হাসির গা-মাথায় হাত দিয়ে বুলাতে থাকে। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। সূয্যিমামা পূবদিকে উঠবে বলে জানান দিতে শুরু করেছে। মায়ের আদরে হাসির ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনিতা বলে, ’মাগো তুই ভালো থাহিস।’ হাসি থতমত খায়। সে ধড়পড় করে উঠে বসে। খুব বিচলিত হয়ে জানতে চায়, ’কি হইছে মা তোমার? আমারে ভালো থাকতি বলতিছো কেন? আমি খারাপ থাকলি তুমি দ্যাখপা না? আমার খারাপ থাকার কথা কেন বলতিছো।’ অনিতা যেন মুখটা আড়াল করতে চেষ্টা করে। মুখে সে বলে, ’না-রে মা, এমনি কলাম। আচ্ছা, আমি একটু চালনায় যাচ্ছি, তোমার মামাদের ওইহেনে। রোদ চড়লি কষ্ট হবে, তাই রোদ উঠার আগেই রওনা দিচ্ছি। ফিরতি রাত হয়ে যাবেনে। তুমি কিন্তু স্কুলি যাইও। আইসে খাইয়ে নিও।’
মায়ের কণ্ঠে কেমন যেন এক অচেনা সুর। ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে সে আবার শুয়ে পড়ে। এই ভোরবেলায় মা চলে যাচ্ছে। সত্যিই মামা বাড়িতে কি কারও কিছু হ’ল? বাবাও নেই। সে কয়েকদিন আগে কাজে গেছে, সেই ফকিরহাট। কবে আসবে ঠিক নেই। এখন আবার মামাদের কি হ’ল! হাসি বলে, আচ্ছা, মা, তুমি কি একলা যাবা। না-কি, সমীরণ কাকুরে নিয়ে যাবা?
দেহি, সে যায় কি-না! অনিতা জবাব দেয়। মিঠুকে বুকে নিয়ে অনিতা বেরিয়ে পড়ে।
সেই যে গেল, আর তার মা ফিরে আসেনি। অনিতা বেরিয়ে নৌকায় উঠে ঢাকি পেরিয়ে বটবুনিয়া পৌঁছায়। ততোক্ষণে সমীরণ তার সাথে যোগ দিয়েছে। ঠিক করা ছিল মটর সাইকেল। তাতে চড়েই খুলনার গল্লামরী মোড় হয়ে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ। সেখান থেকেই ইছামতি নদী পারে এক বাড়িতে গিয়ে আঁধারের জন্যে অপেক্ষা। সন্ধ্যার আঁধার গাঢ় হলে সীমান্ত রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে নদী পার হয়ে হিঙ্গলগঞ্জ পৌঁছানো। সেখান থেকে নৈহাটি।
অনিতার চলে যাওয়ার কথাটি ফকিরহাট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কথাটি শোণার পর শিবু আরও বেশী চুপচাপ হয়ে পড়ে। আগের সেই ঠাট্টা-মশকরা আর কেউ করতে সাহস পায় না। অনেকেই বলেছে, অনিতা চলে যেতে পারে। তারও মনে হয়েছে, তাই বলে সত্যি সত্যি অনিতা নিজের মেয়েকে ফেলে এভাবে চলে যাবে, তা শিবু ভাবতে পারেনি। কোথাও যেন তার একটু আশা ছিল। মায়ের মন। মা কি করে সন্তানকে ফেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু জীবনের চাহিদার কাছে সবকিছুই এলোমেলো করে দিতে পারে। আপনজন, নাড়িছেঁড়া ধন, এসবও তুচ্ছ। তাই সেটি পেটের চাহিদা হোক, আর দেহের চাহিদা হোক। তখন চাহিদা পূরণই একমাত্র লক্ষ্য।
ওইদিন রাত হলেও মা না ফেরায় হাসি খুব কেঁদেছিল। এর আগেই কারা যেন বাঁধের পাড়ায় খবর দেয়, শিবুর বৌ অনিতা সমীরণের সাথে চইলে গেছে। হাসির কানেও কথাটি আসে। সে বিশ^াস করতে পারেনি। মা যে তার মামাবাড়ি যাবে বলে গেছে। সকালে-দুপুরে মেঝ জেঠিমা ডেকে নিয়ে খাইয়েছে। এই মেঝ জেঠিমাই তাকে খুব আদর করে। তার কাছে কিছু জানতেও চায়নি। বলেছিল, ’তোমার কিছু রান্না করতে হবে না। আমার কাছে গিয়ে খাইয়েনে। কান্নাকাটি করবা না।’
বাবা ফিরেছিল চারদিন পর। শিবপদ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে পড়ে। দিন যায়, কাজকামও ছেড়ে দেয়। একেবারে ত্রাণের সামান্য কিছুর উপর নির্ভর করতে থাকে। আর কারণে-অকারণে মেয়েকে শাসন করতে শুরু করে। বকাবকি করে, এমনকি গায়েও হাত তোলে। কয়েকদিন পর পাশের বাড়ির সুধীর কাকা হাসিকে বলেছিল, তার মা ভারতে গিয়ে সেই সমীরণ কাকুর সাথে বিয়ে করেছে। নতুন সংসার করছে। সমীরণ কাকুর কাছেই থাকে তার মা। ছোট বোনটিও সেখানে থাকে। মিঠুকে তার খুব মনে পড়ে। মায়ের কথাও মনে পড়ে। তবে খুব কষ্ট হয়। মা-তো সরে গিয়ে বেঁচেছে। ক্ষিদের জ্বালা, কথার জ্বালাও তার গেছে। এখন যে বাবার নিত্যদিনের গঞ্জনা তাকেই সইতে হয়। (চলবে)
খুলনা গেজেট/ টি আই