খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫
  গাজীপুরের শ্রীপুরে বোতাম তৈরির কারখানায় আগুনে নিহত ১

রাহুগ্রাস (পর্ব ০৩)

গৌরাঙ্গ নন্দী

শিবুপদ’র জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটেছে। এটি কি ছন্দপতন, না-কি চারপাশটাই এলোমেলো হয়ে যাওয়া, তা সে বুঝতে পারে না। চৌদ্দ-পনের বছরের কিশোরটির শরীরে-মনে-চারপাশে অনেক পরিবর্তন! সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখা, তেঁতুল-গুড় দিয়ে ফ্যানা ভাত খাওয়া, গরুগুলো মাঠে ছেড়ে দেওয়া, বন্ধুদের সাথে হল্লা করা, ঢাকী-ভদ্রা-কপোতাক্ষ দিয়ে ছোট নৌকায় করে ভাসতে ভাসতে সুন্দরবনের মধ্যে যাওয়া। বন কর্তাদের চোখ এড়িয়ে খানিকটা গিয়েই ফিরে আসা। নদী থেকে খাল, ভারানি বেয়ে এগিয়ে যাওয়া। দু’পাড়ে গেওয়া, কাঁকড়া, বাইন গাছের সারি। মাঝে-মধ্যে সুন্দরী। পাখিদের কিচির-মিচির। গা ছমছম করা ভাব। ওই কি যেন নড়েচড়ে উঠেলো! তবে কি বাঘ মামা! বানরটা ডাল ধরে এপাশ হতে ওপাশে কেন গেল! না, না, আর ভিতরে যাওয়া যাবে না। অজানা শঙ্কায় তাড়াতাড়ি ফিরে আসা।

এখন সব যেন অচেনা হয়ে গিয়েছে। বিলে নোনা পানি উঠেছে। গরুগুলো ছেড়ে দেয়া যাবে না। বাবা-মা বারে বারে সাবধান করেছে, ‘গরুগুলো ছাড়বি না, শিবে। কুটো কাইটে দিতি হবে।’ এভাবে তোলা খাবার খাইয়ে কি গরুগুলোর চাহিদা মেটে। আর বারে বারে সতর্কবাণী। ‘দেখো, তুমি কিন্তু বারে বারে নদীর ধারে যাবা না। সারাদিন টো টো কইরে ঘুরে বেড়ানো কমাও। শহুরে লোকেরা আইসে জ্বালানো শুরু করিছে। এর শেষ কোন খানে তাতো জানা নেই।’

কেমন যেন দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ঢাকীর পাড়ে গাছের সারি। তার ছায়ায় বসে ডাঙগুলি খেলা। আর নদীতে ট্রলার, বড় বড় কার্গো যেতে দেখা। সেই কোন হুগলি বন্দর থেকে মালামাল ভরে সুন্দরবনের নদীগুলোর মধ্যে দিয়ে এঁকে-বেঁকে আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে চালনা-মংলা হয়ে ঢাকা গিয়ে পৌঁছনো। ঢাকা আমাদের রাজধানী। অনেক বড় শহর। অনেক আলো ঝলমলে শহর। শ্যামল দা’র কাছে ঢাকার গল্প শুনে যেতে চেয়েছিল সে। শ্যামল দা’ কথাও দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আর একটু বড় হ’, তারপর নিয়ে যাবো।’ আহা, আমি কি আর কোনদিন ঢাকায় যেতে পারবো। আমি ঢাকা শহরের আলো ঝলমল রাস্তাঘাট দেখতে পারবো। এখানেই যেমন এখন হাঁঁটতে গেলে বাধা, বসতে গেল বাধা, কিছু করতে গেলে বাধা। গাছের পাতাগুলোও যেন ঠিক-ঠাক নড়ছে না। পাখিগুলোও যেন উড়ছে না। গরুগুলোও যেন ডাকতে ভুলে যাচ্ছে। বন্ধুরাও কেমন যেন মন-মরা। সকলের মাথায় যেন একরাশ দুশ্চিন্তা। ভয়। আতঙ্ক। কোন এক অজানা আতঙ্ক সকলের ভাবনার তাল কেটে দিয়েছে।

বিপীন স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল, ভয় হচ্ছে একটি রোগ। সবলেরা ভয় পাইয়ে দিয়ে দুর্বল মানুষদের ঠকায়। আমাদের সমাজটায় এক ধরণের ভয় আছে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওটা বলা যাবে না। মা-বাবারাও ছোট বেলা থেকেই শিশুদেরকে বলে, ওখানে যেও না, পড়ে যাবে; ওটা করবে না, তোমাকে মানায় না। স্যারের মতে, এভাবে না বলে সবকিছু বুঝিয়ে বলা উচিত। পড়াশোনাটাও মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে শেখাতে চায়। ইংরেজি, ওরে বাব্বা, খুব শক্ত ভাষা! অংক, সেতো অনেক মাথা খাটানোর বিষয়! এটা ঠিক নয়। আমাদের দেশের শিশুরা ঠিকঠাক পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে না এই কারণে। বিপীন স্যারকে শিবু মাথা থেকে সরাতেই পারছে না। লোকটিকে আজ তার অনেক বেশী ভালো লাগছে। কিন্তু সকলেই বিপীন স্যারকে আড়ালে পাগলা স্যার বলে। আবার তাঁকে সমীহও করে। সামনা-সামনি তাঁর সাথে কেউ কথা বলার সাহস করে না! সবাই বলে, স্যার ভালো জানেন, বলেনও ভালো; কিন্তু পাগলাটে। সকলের সাথে তিনি মেশেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের কখনও মারেন না। বড়জোর ধমক দেন। যে কোন বিষয়ই বুঝিয়ে বলেন। একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে যায়।

আজকের এই বিরুদ্ধ পরিবেশে স্যারের কথা খুব মনে পড়ে শিবুর। এভাবেই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলে যায় ক’টা দিন। ভোর হয় কেমন যেন ভারী হয়ে। বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন মানুষের মনগুলো। কোন কিছুতেই ভালো লাগে না। কেমন যেন এক অস্থিরতা। যাদের জমি নিয়েছে চুক্তি করে, তাদেরকে বাদ দিলেও এই গ্রামের অনেকের জমিতে নোনা পানি উঠেছে, তাদের সাথে দখলদাররা কথাবার্তা বলতে চায় না। অনেকেই দেখা করেছিলেন লুৎফর সাহেবের সাথে; পূর্ব পরিচয় থাকার সুবাদে কেউ কেউ গিয়েছিলেন খুলনায় হাসান সাহেবের কাছে। ঘন্টা দুই বাইরে অপেক্ষায় থাকার পর হাসান সাহেব তাদের সাথে কথা বলেছে। জানিয়ে দিয়েছে, ওই জমিতে চিংড়ি চাষ হবে। তোমাদের যাদের সেখানে জমি আছে, প্রতি বছর হারি বাবদ দুই হাজার করে টাকা পাবে। তবে টাকা এখুনি পাবে না, তোমরা গ্রামের মানুষেরা জমি লিজ দেয়ার দলিল করে দেও। আগে দলিল হবে। তাও পাঁচ বছরের জন্যে জমি দিতে হবে। সেই চুক্তিপত্র পাওয়ার পর বছর বছর টাকা পাবে। এসব কথা শুনে খুবই হতাশ হয়ে তারা গ্রামে চলে আসেন। কেউ কেউ থানায় গিয়েছিল অভিযোগ করতে। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ কোন অভিযোগ নেয়নি। বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের কি হাল!

জীবন স্যার আরও বেশী মুষঢ়ে পড়েছেন। তিনি সেদিন বেশ হতাশকণ্ঠেই গ্রামবাসীদের বলেছেন, ‘কি যে করা উচিত, তা আমি বুঝতে পারছি না। দখলদাররা অনেক শক্তিশালী। আমাদের ক্ষমতা নেই, টাকা-পয়সাও নেই; গরীব, বাদার পাড়ের মানুষ, আমাদেরতো কোন কথার দাম নেই। আমরা কিভাবে তাদের সাথে পারবো! তাদের সাথে আমরা পেরে উঠবো না। আবার গ্রামের কেউ কেউ ওইসব দখলদারদের সাথে ভিতরে ভিতরে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ফলে পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ঠিক বলা যায় না।’

কয়েকদিন পরের সকাল বেলাটা ছিল আরও দু:স্বপ্নের। শিবু ঘুম থেকে কেবলি উঠে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছে। দূরে নদীর পাড়ে অনেক মানুষের জঁটলা দেখতে পায়। সে সেদিকে ছুটে যায়। হ্যাঁ, নদীর পাড়ে অনেক মানুষের ভীড়। জটলা। হৈ-হট্টগোল। শিবু এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে একটি মৃতদেহ ঘিরে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ আর্তনাদ করছে। কেউ কেউ ঘটনাটি কিভাবে ঘটতে পারে, তাই নিয়ে নানান মতামত দিচ্ছে। যে মারা গিয়েছে তার নাম দেবাশীষ। বাড়ি উত্তরপাড়ায়। এই বাঁধ কাটার শুরুর দিন থেকেই সে খুব সোচ্চার ছিল। কিভাবে এই দখলদারদের হঠানো যায়, তাদেরকে মোকাবেলা করা যায়, এ কারণে দৌড়ঝাঁপও করছিল। এলাকার যুবকদের সংগঠিত করা এবং এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিল। সেই দেবাশীষের লাশ পড়ে আছে। কে কিভাবে হত্যা করতে পারে, তাই নিয়ে আলাপ-আলোচনা, কানাঘুষা। সকলেরই এক কথা। চিংড়ি চাষীর লোকেরাই তাকে হত্যা করেছে, যাতে গ্রামের মানুষেরা ভয় পায়, কিছু না বলে। প্রতিবাদ না করে। এ কারণে রাতের আঁধারে দেবাশীষকে একা পেয়েই হত্যা করেছে। আবার গ্রামের এক কোণে, নদী-বাঁধের পাশে লাশ ফেলে রেখেছে। দেবাশীষের মা মৃতদেহর উপরে আছড়ে পড়ে কেঁদে চলেছেন। জীবন স্যার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘এই সবে শুরু, আরও কতো কি যে দেখতে হয়; উপরওয়ালা জানেন!’

হ্যাঁ, অনেক কিছুই শুরু হয়েছে। এরই মাঝে এই শহুরে আপদগুলো বনে ঢুকে হরিণ মেরে নিয়ে এসেছে। বনে সকলে এভাবে যায় না। এর নিয়ম-কানুন আছে। নিয়ম না মানলে বন-মাতা- বনবিবি রাগ করেন। শিবুর মনে প্রশ্ন জাগে, তাইতো, আমাদের বনে যাওয়ার জন্যে কতো নিয়ম! বনে যেতে হলে বন বিভাগের লোকদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। কি জন্যে যাওয়া হবে, কতজন যাবে, সেখানে গিয়ে কি করবে, নৌকার আয়তন কেমন? সবই জানাতে হয়। সেসব দেখে-শুনে বন-কর্তা অনুমতি দেন। এজেন্য সরকারকে টাকা দিতে হয়। মাছ ধরার জন্যে এক নিয়ম, মধু সংগ্রহের জন্যে এক নিয়ম, কাঠ এবং গোলপাতা সংগ্রহের নিয়ম ও ফিস আলাদা। হরিণ মারা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজটি কয়েকজন বন্দুকধারী কিভাবে সহজে করে ফেললো। এই বন্দুকধারীদের সাথে না-কি এরই মধ্যে বন-কর্তাদের ভাব হয়ে গেছে। তাদের সহযোগিতায় তারা হরিণ মেরে এনেছে। সেই হরিণের মাংস খেয়ে ওরা উল্লাস করেছে। শিবু পরিষ্কার বুঝতে পারে, আসলে শক্তির কাছে সবই পরাভূত। যে যতো শক্তিশালী, সেই ততো অনিয়ম করতে পারে। নিয়ম রক্ষার মানুষগুলোও শক্তির কাছে পদানত। গরীব, দুর্বলের জন্যে আইন-কানুন, নিয়ম, বিধিনিষেধ! সব স-ব। কিন্তু ধনী, বড়লোকদের জন্যে সব-কিছু মাফ।

দুপুরের দিকে ট্রলারে চড়ে থানার দারোগা ও একাধিক পুলিশ সদস্য আসেন। পুলিশ খুঁটিয়ে খুঁিটয়ে লাশটি দেখে। কোথায়, কিভাবে লাশটি পাওয়া গেলো; কে আগে লাশটি দেখেছে, জানতে চায়। কেউ কোন কথার জবাব দেয় না। একেবারে চুপচাপ। বাতাসের শব্দ ছাড়া, কারও মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোয় না। দারোগা হানিফের মেজাজ বিগড়ে যায়। রেগে ওঠেন। চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘কি ব্যাপার, কেউ কোন কথা বলছে না, কেন? কে লাশটি প্রথম দেখেছে?’

উপস্থিত সকলেই চুপচাপ। একজন, আর একজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কিন্তু কেউ কোন জবাব দেয় না।

এবারে দারোগা হানিফ দেবাশীষের মাকে লাশ দেখিয়ে জিগ্যেস করে, ‘এই বুড়ি, এ তোমার কি হয়?’

‘আমার ছাওয়াল’, বাবু।

তুমি কিভাবে ওর খবর পেলে?

কে যেন, বলিলো, তুমাগে দেবাশীষ ঘাটের পাশে মইরে পইড়ে আছে। শিগগির যাইয়ে দেহো। আমি তাই শুনে দৌড়ে এহেনে চইলে আইছি। এইহেনে আইসে দেহি, কয়েকজন ওরে ঘিরে আছে। কে যে পরথোম দেহিছে, তাতো কতি পারবো না।

হানিফ দারোগা আবারও রেগে-মেগে বলেন, তাইলে কে লাশ প্রথম দেখিছে, তা জানা গেলো না। কেউ প্রথমে লাশ দেখিনি। সকলেই শুনে শুনে চইলে আইছে।

একজন কনস্টেবল লাশটিকে ঘুরিয়ে দেখছিল, আর একজন তার বর্ণনা লিখছিল। নাম দেবাশীষ মন্ডল। বয়স ২৪। বাবা কামনাশীষ মন্ডল। স্বাস্থ্য সুঠাম। শরীরের পিঠে, বুকে, পেটে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত। গলায় একটি ক্ষত, সেটাও ধারালো অস্ত্রের। পরনে চেক লুঙ্গি। গায়ে একটি কালো রঙ-এর গেঞ্জি। গেঞ্জিটির নানান জায়গায় রক্তের দাগ। ঘটনাস্থল, ধোপাদি খেয়াঘাটের পাঁচশ’ গজ দূরে। তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪।

লাশটি একটি হোগলাপাতার মাদুরে পেঁচিয়ে ওই ট্রলারে তোলে। দেবাশীষের মা অঝোরে কেঁদে চলেছে। কার কাছে যেন জানতে চায়, মরা ছেলের লাশটি কি ফেরত পাবে না? কেউ একজন জবাব দেয়, ওই লাশ খুলনা শহরের হাসপাতালের মর্গে যাবে। সেখানে লাশ কাঁটা-ছিড়া হবে, তারপর পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর হবে। পরিবারের কোন একজনকে হাসপাতালে আসতে বলে হানিফ দারোগা তার দলবল নিয়ে ট্রলার ওঠে। হুকুম দেয় ট্রলার ছাড়ার। ঢাকির পানি চিরে ট্রলারটি এগিয়ে যায়। ক্রমশ: ট্রলারটি ছোট ছোট হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।

এর দু’দিন পর থেকেই শুরু হয়ে যায় গ্রামে পুলিশের আনাগোণা। তারা গ্রামের কয়েকজন যুবককে আটকও করে। সকলেই দেবাশীষের বয়সী। তারা একসঙ্গে চলাফেরা করতো। পুলিশ দেবাশীষের বাপ-মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, কারা মারতে পারে। তারা কাউকে সন্দেহ করে কি-না। তারা জানিয়েছে, ‘দেবাশীষের বা আমাইগে পরিবারের সাথে কারুরই শত্রুতা ছিল না। ফলে পাড়ার কেউ তাকে মারতে পারে না। ওই চিংড়ি চাষী আসার পর গ্রামে অশান্তি দেখা দেয়। ওর বন্ধুরা মিলে এর বিরোধিতা করছিল, ফলে তাদের ধারণা ওই চিংড়ি চাষীর লোকজন তাকে মারতে পারে।’ কিন্তু পুলিশ বেছে বেছে গ্রামের যুবকদের ধরে নিয়ে থানার গারদে পুরতে থাকে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মারধরও করে। জানতে চায়, কে তাকে কিভাবে মারলো। কিন্তু আশ্চর্য। দেবাশীষের মা-বাবা, গ্রামের মানুষজন বলেছে, তাদের সন্দেহ ওই চিংড়ি চাষীর লোকজনই ওকে পিটিয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। পুলিশ তাদের কাউকে ধরেনি। তাদেরকে কোন জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। উল্টো তাদের হয়ে পুলিশ গ্রামবাসীদের ধমকেছে। বলে কি-না, ‘নিজেরা শত্রুতা করে মেরে তাদের নামে দোষ দেয়া হচ্ছে। তারা সরকারের অনুমতি নিয়ে, জমি মালিকের সম্মতি নিয়ে চিংড়ি চাষ করতে এসেছে। তারা কেন মানুষ মারবে!’

জীবন স্যার দারোগা বাবুকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, ‘না দারোগা বাবু। এখানকার সকল জমির মালিকের সাথে চিংড়ি চাষীর চুক্তি হয়নি। সকল জমির মালিক তাদের জমি দেয়নি। শহরের তিনজন জমির মালিকের জমি তারা নিয়েছে। সবমিলিয়ে তাদের জমির পরিমাণ দুশো বিঘের মতো। কিন্তু এই চিংড়ি চাষীতো নোনা পানি তুলে হাজারখানেক বিঘে জমি ভাসিয়ে দিয়েছে। এখন বলছে, এই জমিতেই তিনি চিংড়ি চাষ করবেন। এখানে এই গ্রামের শতাধিক মানুষের জমি আছে। কারও দু’বিঘে আছে, কারও আছে পঞ্চাশ বিঘে। এই জমিতেও উনি নোনা পানি তুলে তার দখল নিলেন। আমাদের সাথে কোন কথা বলেননি। অল্প জমির মালিকদের সাথে কথা বলে বেশী জমি দখলে নেয়া কি অন্যায় না? বাঁধ কাটা কি অন্যায় না?’

দারোগা বাবু এসব কথার জবাব দেয়নি। তার সাফ কথা। লতিফ সাহেব ভালো লোক। সরকার চাইছে চিংড়ি চাষ হোক। চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মূদ্রা আসুক। ডলার আসুক। তিনি সরকারের অনুমতি নিয়ে কাজ করছেন। খারাপ কিছু করছেন না। আর জমির কথা বলছেন। এই সময়েতো আপনারা জমি ফেলে রাখেন। কিছুই হয় না। মাঠ জুড়ে গরু চরে। আপনারাতো ওই এক বর্ষার সময় আমন ধানের চাষ করেন। তখন করবেন। যখন, আপনাদের জমি ফেলানো থাকে, তখন চিংড়ি চাষ হবে। এ কারণে তিনি আপনাদের জমির ভাড়া দেবে। এতেতো আপনাদের বাড়তি আয় হবে। আর বাঁধ কাটার কথা বলছেন। বাঁধের মাালিকতো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড -বা-পাউবো। তাদের বাঁধের ক্ষতি হলে তারা বলবে। তারা কিছু বলছে না। তার জন্যে তো আপনাদের মায়া কান্নার কিছু নেই। আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন, আমিতো বুঝতে পারলাম না। দারোগা বাবু খুবই বিরক্তি প্রকাশ করেন। শেষে বলেন, দেখুন, সরকারের ইচ্ছা চিংড়ি চাষ হোক; ফলে চিংড়ি চাষ হবেই। এতে আপনারা অহেতুক বাধা দিয়ে ঝামেলা করবেন না। তাহলে আপনাদের বিরুদ্ধে সরকারের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হবে।

কি অবস্থা! সরকার জমি এক্যোয়ার করে শুনেছি। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জমি নেয় সরকার। এজন্যে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়। আর এতো দেখি, সরকারের ছত্রছাত্রায় কিছু মানুষের গুন্ডামি। আমি জমির মালিক, আমার জমি, আমি কিভাবে ব্যবহার করবো, সে অধিকার আমার থাকবে না। কোথাকার কে এসে বললো যে, তিনি তাতে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করবেন। আর সেটাই সরকারের ইচ্ছা!

শিবু’র কাছে মাত্র ক’টা দিনেই নিজের গ্রামটাও যেন অচেনা হয়ে গেল। গ্রামবাসীর মুখে হাসি নেই। বন্ধুদের নিয়ে আর হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়িও করা হয় না। কোন কিছু ভালোও লাগে না। সকল মানুষের মুখ ভার। হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে। উচ্ছ্বাস শুধু ওই দখলদারদের লোকেদের। নদীতে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। সকালে সূর্য উঠছে, ভোরের আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বলতা ছড়ায়। আবার সন্ধ্যে নামে। আঁধার গাঢ় করে আসে। আবার ভোর হয়। তবে মানুষের মধ্যে চেপে বসা এই আঁধার দূর হওয়ার কোন সঙ্কেত দেখা যায় না। (চলবে)

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!