বাগরহাটের রামপালের বহুল আলোচিত জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান খাঁজা মঈন উদ্দিন আক্তার হত্যা মামলায় ১৭ আসামির বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বাগেরহাটের সিআইডি ইন্সপেক্টর শাহানা আফরোজ খাঁন চৌধুরী পৃথক ২ টি মামলায় গত ২০ জুলাই বিজ্ঞ আদালতে সমপূরক ১৩২ ও ১৩২ (১) অভিযোগপত্র দুইটি দাখিল করেন।
মামলা ও অভিযোগপত্রের সুত্রে জানা গেছে, রামপাল উপজেলার উজলকুড় ইউনিয়নের সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক খাঁজা মঈন উদ্দিন আক্তার ইং গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালের সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় ভরসাপুর বাস স্ট্যান্ড বাজারের কমল কুমার বালার দোকানের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি আহাদ শেখ, আজিম শেখ, বাকিবিল্লাহ বেপারী, বাবুল কাজী ওরফে কাজী আসাদুজ্জামান, শিবলু আকুন্জীসহ পাঁচ/ছয় জন একটি প্লাষ্টিকের ব্যাগ নিয়ে খুলনা- মোংলা মহাসড়কের ভরসা পুর বাসস্টান্ডের দিকে আসেন। এ সময় পাশের একটি গলির মধ্যে আসামি বাবুল কাজী, শিবলু আকুঞ্জিসহ সাত/আটজন দাড়িয়েছিল। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহাদ শেখ খাঁজা মঈন উদ্দিনকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে। এতে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় তারা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
পরে গুরুতর আহত চেয়ারম্যান আক্তারকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই রাতেই মারা যান। নিহত চেয়ারম্যান খাঁজা মইন উদ্দিন আক্তার বামনডহর গ্রামের মরহুম সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মৃত সোবহান শেখের ছেলে। এ ঘটনার পর তার শ্বশুর সাহেব আলী আকুঞ্জী বাদী হয়ে রামপাল থানায় ওই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে রামপাল থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক তুহিন হাওলাদার এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি ২০১৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখ থেকে ০৭/০৩/২০১৯ তারিখ পর্যন্ত তদন্ত করেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি বাগেরহাটের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে মামলার নথি হস্তান্তর করেন। ওই প্রতিবেদনের নথি পেয়ে পিবিআই এর তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গৌতম চক্রবর্তী তদন্তে নেমে মামলার আসামি শিবলু আকুঞ্জীকে আটক করে জেল হাজতে পাঠান। পিবিআই এর ওই কর্মকর্তা বদলী হয়ে গেলে পুলিশ পরিদর্শক শেখ শহিদুল ইসলাম তদন্তের দায়িত্ব পান। এরই মধ্যে মামলার অন্যতম আসামি আহাদ শেখ ও আজিম শেখ আদালতে আত্মসমর্পন করেন। জিঞ্জাসাবাদে আহাদ শেখ আদালতে হত্যার দ্বায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন।
এরপর শহিদুল, খালেকুল ও তানভীর শেখকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে তদন্তে ওই আসামিসহ এজাহার নামীয় আসামি বাবুল কাজীসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত না হওয়ায় তাদেরকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়। পিবিআই ইনস্পেক্টর শেখ শহিদুল ইসলামের মনগড়া অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। পরবর্তীতে মামলার বাদী খাঁজা মঈন উদ্দিনের শ্বশুর আলহাজ্ব সাহেব আলী আকুঞ্জী ওই অভিযোগ পত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজীর আবেদন করেন। আদালত নথি পর্যালোচনা করে অধিকতর তদন্তের জন্য বাগেরহাটের সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
সিআইডি’র ইনস্পেক্টর শাহানা আফরোজ খান চৌধুরী গত ৩১/১২/২০২১ তারিখ এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তদন্তে আসামি আহাদ শেখের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতে জানায় বিগত ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আসামি বাবুল কাজী ফয়লা বাজারের অটো রাইস মিলে বসে ওই হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।
১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে আহাদ চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়ায় তার সূত্র ধরে সিআইডি ইন্সপেক্টর শাহানা আফরোজ অব্যাহতভাবে তদন্ত কার্যক্রম চালাতে থাকেন। একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। চার্জশিটভুক্ত আসামি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশিকুর রহমান আশিক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মল্লিক মিজানুর রহমান মজনু, সাংবাদিক আজিম শেখ ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা বাবুল কাজী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিতে এ হত্যার ছক প্রস্তুত করেন।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয় আক্তার চেয়ারম্যানের সাথে রাজনৈতিক ও জমি নিয়ে বিরোধ এবং নিহত চেয়ারম্যানের শ্বশুর সাহেব আলীর জমি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। বাবুল কাজী আক্তার চেয়ারম্যানকে পথের কাটা মনে করে তাকে দুনিয়া থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন বলে সিআইডির তদন্তে উল্লেখ করা হয়।
নৃশংস ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় সর্বশেষ ২০/০৭/২০২২ তারিখ সিআইডি ইন্সপেক্টর শাহানা আফরোজ বিজ্ঞ আদালতে মো. আহাদ শেখ, এম এ আজিম, বাকিবিল্লাহ ব্যাপারী, বাবুল কাজী ওরফে কাজী আসাফুজ্জামান, শিবলু আকুঞ্জী, শহিদুল ইসলাম মোড়ল, মো. খালিকুল শেখ, মো. দেলোয়ার ফকির (৫২), মো. তানভীর হাসান, আশিকুর রহমান আশিক, মিলন আকুঞ্জী, মো. শুকুর ফকির, মো. শাহাজান শেখ, আইয়ুব আলী শেখ, হাওলাদার রিজাউল করিম, মো. শাহিনুর ইসলাম ও মো. আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেছেন। মল্লিক মিজানুর রহমান মজনু গত ফেব্রুয়ারিতে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তাকে অব্যাহতির জন্য সুপারিশ করা হয়।
তবে জামিনে থাকা আসামী বাবুল কাজী ও আজিম জানান, তারা ষড়যন্ত্রের শিকার।
মামলার বাদী সাহেব আলী আকুন্জী অভিযোগ করে বলেন সিআইডি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র দিয়েছেন। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। তারা মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করছে। মামলা তুলে না নিলে তার জামাই এর মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে তিনি অভিযোগ করেন। আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় বর্তমানে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান।
মামলার আইনজীবী ডক্টর এ কে আজাদ ফিরোজ টিপু অসুস্থ থাকায় তার এসোসিয়েট সদস্য অ্যাডভোকেট আবু জাহিদ আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে বাগেরহাটের সিআইডি ইন্সপেক্টর শাহানা আফরোজ খান চৌধুরীর সাথে তার মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, হত্যার ঘটনায় ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দুইটি অভিযোগ পত্র বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করে বিচার প্রার্থনা করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ এস আই