খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ময়মনসিংহে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে একই পরিবারের ৪ জন নিহত
  নিখোঁজের ৪২ ঘণ্টা পর কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদী থেকে দুই পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার

রাজপ্রাসাদ নয়, রাজপথই ছিলো এড. ফিরোজ আহমেদের ঠিকানা

এড. কুদরত-ই-খুদা

এড. ফিরোজ আহমেদ যিনি ছাত্র জীবনে ছিলেন একজন তুখোড় ছাত্র নেতা। রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন একজন খাঁটি কমিউনিস্ট। ছাত্র জীবনে যার আগুনঝরা বক্তব্য শুনে অনেক ছাত্র/ছাত্রী তার মতো রাজনীতিবিদ হবার স্বপ্ন দেখতেন।

রাজপ্রাসাদ নয় রাজপথের আন্দোলনই ছিলো এডঃ ফিরোজ আহমেদের একমাত্র ঠিকানা। শ্রমিক, মজুর, কৃষক ,মাঝি, বস্তির মানুষের ভাগ্য উন্নয়নই ছিলো তার একান্ত ভাবনা। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় এডঃ ফিরোজ আহমেদ কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। যে কারণেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিলো কন্টকাকীর্ণ।

এডঃ ফিরোজ আহমেদ রাজনীতি করে মেয়র হতে পারেননি, মন্ত্রী হতে পারেননি বটে কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন ঠিকই। তার রাজনীতি ছিলো সকালে ঘুম থেকে উঠে খুলনা নগরীর কোথায় কোন শ্রমিক অসুবিধায় আছে, কোন বস্তির মানুষ অসহায় জীবন যাপন করছে, তাদের কাছে ছুটে যাওয়া এবং সাধ্যমত সহযোগিতা করা।

বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের ধারণা ক্ষমতায় না গিয়ে মানুষের সেবা করা যায় না, কিন্তু ক্ষমতায় না গিয়েও মানুষের সেবা করা যায় তার প্রকৃত উদাহরণ এডঃ ফিরোজ আহমেদ। তিনি ছিলেন আজীবন একজন সংগ্রামী মানুষ। অসহায় ও মেহনতি মানুষদের অধিকার আদায়ে কখনো মেয়রের বিরুদ্ধে, কখনো কেডিএর বিরুদ্ধে আবার কখনো সরকারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন স্বোচ্ছার কন্ঠ। তিনি সকলকে সাথে নিয়ে মিটিং মিছিল, মানববন্ধন করেছেন। অনশন করেছেন আবার কখনো অবস্থান ধর্মঘটও করেছেন।

এডঃ ফিরোজ আহমেদ দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর মধ্যে ক্ষমতার কোন মোহ ছিলো বলে মনে হয়নি। ক্ষমতার মোহ থাকলে হয়তো তিনি পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কথা বলতে পারতেন না বরং সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদ হতেন। এডঃ ফিরোজ আহম্মেদ ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে তিঁনি যেটা ভালো মনে করতেন সেটাই করতেন কিম্বা বলতেন। ক্ষমতায় যাওয়া নয়, মানুষের সেবায় এগিয়ে যাওয়াই ছিলো তার জীবনের ব্রত।

অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বর্তমান রাজনীতি হচ্ছে, যে কোন ভাবে ক্ষমতায় যেতে হবে এবং ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখতে হবে। দেশের উন্নয়নের নামে নিজেদের উন্নয়ন করতে হবে। তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে হবে। এডঃ ফিরোজ আহমেদ সেটা করতে পারেননি বলেই রাজনীতির তকমা ছিড়ে নিজের অজান্তেই নাগরিক সমাজের নেতা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রমান করতে চেয়েছিলেন ক্ষমতায় না গিয়েও সাধারণ মানুষের পাশে থাকা যায় এবং তাদের সেবা করা যায়।

রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হচ্ছে, যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা। বর্তমান রাজনীতিতে যেটা ভীষণ ভাবে চর্চা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে নাগরিক সমাজের লক্ষ্য হচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া নয় বরং যারা ক্ষমতায় যান তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা। অর্থাৎ সরকার কিম্বা রাষ্ট্র কোন অন্যায়-অনিয়ম করলে সমাজের বিবেক হিসেবে তাদের বিরূদ্ধে কথা বলা। প্রয়োজনে নাগরিক মতামত তৈরীতে কাজ করা। এডঃ ফিরোজ আহমেদ নাগরিক সমাজের এই কাজটিই দক্ষতার সাথে করবার চেষ্টা করেছিলেন।

নাগরিক সমাজের একজন নেতা হয়ে খুলনার উন্নয়নে তার অবদান হয়তো আমরা নিদৃষ্ট করে দেখাতে পারবো না কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা এবং প্রশাষনের অনিয়ম এর বিরুদ্ধে ফিরোজ আহম্মেদের ভূমিকা সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রতিবাদের যে ঢেউ তুলতো, সে ঢেউ সরকার ও প্রশাষনের উপর গিয়ে আছড়ে পড়তো। প্রশাষন বাধ্য হতো সমস্যা সমাধানে ভূমিকা নিতে।

মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষার অসাধারণ দক্ষতা ছিলো এডঃ ফিরোজ আহম্মেদের । মানুষের সাথে কিভাবে যোগাযোগ রাখতে হয় সেটা তিঁনি খুব ভালো করেই জানতেন। চাকুরির কারণে আমি যখন ঢাকায় ছিলাম ফিরোজ ভাই চিঠি দিয়ে সব সময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। তখন অবশ্য মোবাইল ছিলো না, তাই পোস্টকার্ড ছিলো সহজ মাধ্যম। খুলনা আইনজীবী সমিতিতে কবে ভোট হবে সেটা সর্বপ্রথম ফিরোজ ভাইয়ের মাধ্যমেই জানতাম। আমি ঢাকায় থাকা অবস্থায় ফিরোজ ভাই পরপর চারবার খুলনা আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি হয়েছিলেন। আমি প্রত্যেক বারই খুলনায় এসে তাঁকে ভোট দিয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছিলো শুধু মাত্র তাঁর যোগাযোগ দক্ষতার কারণে।

অসাধারণ ছিলো তাঁর বাকপটুতা। একবার এরশাদ সরকারের আমলে ঢ়াকায় আইনজীবীদের জাতীয় সম্মেলন হচ্ছিলো। ফিরোজ ভাই তখন খুলনা আইনজীবি সমীতির সেক্রেটারি। সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন সমিতির সেক্রেটারিদের সেখানে বক্তব্য দিতে হতো। সবাই বক্তব্য দিতে দিতে দুপুর হয়ে গেলো। আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার আর কোন ধৈর্য়্য নেই । অনেকে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছেন। এমন সময় খুলনার প্রতিনিধি হিসেবে এডঃ ফিরোজ আহমেদের ডাক পড়লো। ফিরোজ ভাই মঞ্চ উঠে সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করতেই হল ভর্তি সমস্ত আইনজীবীরা একদম চুপ হয়ে গেলো, ক্ষুধা ভুলে গিয়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো তাঁর বক্তব্য শুনলো। এই হচ্ছে আমাদের ফিরোজ ভাই। যেকান বিষয়ের উপরে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বক্তব্য দিতে পারতেন। তিনি বুঝতেন কখন, কোথায়, কিভাবে, কোন কথাটি বলতে হবে।

আমার প্রসংঙ্গে ফিরোজ ভাইয়ের একটা উপস্থাপনা আমাকে আজো আপ্লত করে, যা আমি কোন দিন ভুলবো না। আজ এডঃ ফিরোজ আহম্মেদের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সেই কথাটি দিয়েই আমি আমার লেখা শেষ করবো। সম্ভবত ১৯৯০-৯১ সালের কথা। আমি তখন চাকুরির কারণে ঢাকায় থাকি। গণ সাহায্য সংস্থায় লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের প্রধান। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তখন আইনজীবীদের মানবাধিকারের উপর একটি কোর্স করানো হতো। সব জেলা থেকে আইনজীবীরা এই কোর্সে অংশগ্রহণ করতেন। বাংলাদেশের অনেক নামীদামী ব্যাক্তিরা এখানে ক্লাস নিতেন। এডঃ তুহিন মালিক ছিলেন নেই কোর্সের সমন্বয়কারী। যিনি এখন ডঃ তুহিন মালিক নামে পরিচিত। সৌভাগ্যক্রমে আমিও সেখানে একটা ক্লাস নিতাম। আমার বিষয় ছিলো “ Ngo’s in Bangladesh and Developments”. যথা সময়ে আমি ক্লাসে ঢুকে দেখি ফিরোজ ভাই এবং আর একজন আইনজীবী তাঁর নাম এডঃ আলতাফ হোসেন, যিনি আইনের উপর বেশ কিছু বইও লিখেছেন। বর্তমানে তিনিঁ ঢাকায় একটি আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। ক্লাস নেয়ার সময় পারস্পরিক কুশল বিনিময় ছাড়া কথা বলার কোন সুযোগ ছিলো না। পঞ্চাশ মিনিট একটানা ক্লাস নিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। ঘটনাটি এখানেই শেষ।
এর প্রায় সাত-আট বছর পর অর্থাৎ আমি খুলনায় ফিরে আসার পর সম্ভবত ২০০৭ সালে “নিজেরা করি” নামে একটি এনজিও প্রোগ্রামে রুপসা কারিতাস মিলনায়তনে অতিথি বক্তা হিসেবে যাই। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ফিরোজ ভাই। একটা পর্যায় ফিরোজ ভাই বলতে শুরু করলেন, “এখন বক্তব্য রাখবেন এমন একজন ব্যাক্তি যিনি আমার বয়সে ছোট কিন্তু আমি তাকেঁ শ্রদ্ধা করি।“ এরপর তিঁনি ঢাকার ঐ ট্রেনিং-এর কথা উল্রেখ করে বলতে শুরু করলেন “আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম মানবাধিকারের উপর একটা ট্রেনিং করতে। ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সালমা সোবহান, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামসহ অনেক নাম করা মানুষ আমাদের ক্লাশ নিতেন। দ্বিতীয় দিনে বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ আমাদের ক্লাসে এমন একজন ব্যাক্তি ঢুকলেন যাকে দেখে আমার ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো। অনুভব করলাম নাসিকার অগ্রভাগ ফুলে যাচ্ছে। নিজের মধ্যে একটা লজ্জা বোধও অনুভব করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো ট্রেনিং এর আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো। তারপর সেই ব্যাক্তিটি তার বক্তব্য শুরু করলেন, অবাক হয়ে শুনলাম এবং পঞ্চাশ মিনিট পরে আমার বুকটা আবার গর্বে ভরে উঠলো। কারন ঐ ছেলেটিই আমার খুলনার এবং আমার ছোট ভাই। আজ সে এখানে আমাদের অতিথি নাম এডঃ কুদরত-ই-খুদা। এখন তাকেঁ বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করছি।“ এই হচ্ছে ফিরোজ ভাই যিনি সাধারণ কোন বিষয়কে অসাধারণ করে উপস্থাপনা করতে পারতেন। একজন মানুষকে আবেগে ভাষিয়ে দিতে পারতেন। সেদিনে তার সেই প্রসংশায় আমার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিলো। এই হচ্ছে আমাদের ফিরোজ ভাই।
অনন্ত জগতে আপনি যেখানে আছেন ভালো থাকুন।(ফেসবুক ওয়াল থেকে)

খুলনা গেজেট /কেডি




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!