মহান আল্লাহ তা’আলা এক-অদ্বিতীয় ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ভূমণ্ডল ও নভোমন্ডলসহ গোটা বিশ্ব চরাচরের একমাত্র খালিক, মালিক ও নিয়ন্ত্রক হলেন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন। কারো নিকট তিনি ঠেকা নন; কোন সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর কারো সাথে পরামর্শের প্রয়োজন হয় না। (সূরা বাকারা-১১৭)
তিনি এক-অদ্বিতীয়। প্রশংসা ও ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র তিনিই। কেননা বান্দার সকল প্রয়োজন তিনিই পূরণ করেন। আবার বান্দা নিজ ইখতিয়ারে যা কিছু করে তাও তাঁর দেয়া শক্তিতেই করে। তিনি দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়েছেন সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি সমগ্র জগতের লালন-পালনকারী (সূরা ফাতিহা- ১)
নিশ্চই আমিই একমাত্র আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই; সুতরাং আমারই উপাসনা কর। আর আমার স্মরণে নামায আদায় কর। (সূরা ত্বহা-১৪)
তাঁর তুলনা তিনিই। কোন কিছুই তাঁর মত নয়। (সূরা শূরা-১১)
সূরা এখলাসে তিনি আপন পরিচয় তুলে ধরে বলেন- আপনি বলুন, (ক) আল্লাহ এক, (খ) তিনি অমুখাপেক্ষী, (গ) তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং (ঘ) তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি। (সূরা ইখলাস ১-৪)
ছোট্ট পরিধির এ সূরাটিতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর পরিচয়ের এমন চারটি দিক তুলে ধরেছেন যা একসাথে একমাত্র তাঁর মধ্যেই বিদ্যমান। জগতে বিদ্যমান কোন জাতির কথিত কোন উপাস্যের মধ্যে তা নেই। আর যার মধ্যে এ গুণগুলো নেই সে কোনক্রমেই উপাস্য হতে পারে না। জগতে বিদ্যমান মুর্তিপূজক ও অগ্নিপূজকদের কথিত উপাস্য ও খোদা একাধিক।
ইয়াহুদিরা হযরত উযায়ের আ.কে আল্লাহর সন্তান আক্ষা দিয়ে তাঁকে খোদার আসনে বসিয়েছে। খ্রিস্টানেরা হযরত মরিয়ম আ.কে আল্লাহর স্ত্রী ও হযরত ঈসা আ.কে আল্লাহর সন্তান আক্ষা দিয়ে তাদেরকেও খোদা বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁরা সকলেই মায়ের পেট থেকে জন্মলাভ করেছেন। আবার হযরত মরিয়াম আ. ঈসা আ.কে জন্ম দিয়েছেন। আর কাউকে জন্ম দেয়া বা কারো থেকে জন্ম নেয়া অন্যের কাছে ঠেকা হওয়ার সুস্পষ্ট আলামত। আর যে অন্যের কাছে ঠেকা হয় সে খোদা হতে পারে না। অন্য দিকে মুসলমান ব্যতীত জগতের আর কোন জাতি তাদের খোদাকে একজনে সীমাবদ্ধ রাখেনি। কেননা তাদের একেক খোদার একেক দায়িত্ব যা একজনেরটা অপরজন পারে না। আবার একজন এক কাজ পারলেও অন্য কাজ পারে না। তাইতো মজুসীরা ‘ইয়াজদান’ নামাক কাল্পনিক খোদাকে ভালোর স্রষ্টা এবং ‘আহারমান’ নামক আরেক কাল্পনিক খোদাকে মন্দের সৃষ্টিকর্তা বলে। বলা বাহুল্য, যে একটা পারে আরেকটা পারে না সে একদিকে অযোগ্য। আর অযোগ্য কেউ খোদা হতে পারে না। খোদাদের এহেন অযোগ্যতার ও অসহয়াত্বের বিষয় পূজকরাও জানতো।
একটি হাদিসের বিবরণ তুলে ধরলে বিষয়টি আশা করি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. বলেন- আমার পিতাকে নবীজি স. জিজ্ঞাসা করলেন, হে হুসাইন! আজকাল কয়জন মা’বুদের পূজা কর? আমার পিতা বললেন, সাত জনের; ছয় জন জমিনের আরেকজন আসমানের। নবীজি স. বললেন আশা ও ভয়ের সময় কাকে ডাকার উপযুক্ত মনে কর? আমার পিতা বললেন যিনি আসমানে আছেন তাঁকে। (তিরমিযী-৩৪৮৩)
পাঠক! হযরত রসূলে করীম স.-এর প্রশ্নের উত্তরে হযরত ইমরানের পিতা হুসাইন সাত খোদার দাবি করেছে বটে, তবে বান্দার মনের কোন আশা পূরণে তিনি আসমানের জনকেই উপযুক্ত ও যোগ্য ভেবেছেন। আবার কারো শাস্তির বা গজবের ভয় যদি করতে হয় তাহলেও সেই আসমানের জনকেই উপযুক্ত ও যোগ্য ভেবেছেন; অন্যদেরকে নয়।
বিষয়টি কুরআনে এ ভাবে বিবৃত হয়েছে- হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন দুর্বল। (সূরা হজ্ব-৭৩)
বোঝা গেল কত অসহয় তাদের খোদার দল এবং কত বোকার সর্গে বাস করে তারা নিজেরা। হযরত ইবরাহিম আ. কথিত নমরুদ খোদার কারখানায় তৈরিকৃত ছোট-বড় বিভিন্ন খোদাসমূহের সবগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বড় খোদার কাঁধে কুঠার ঝুলিয়ে রাখলেন। তারা দেখে যারপরনাই ব্যথিত হলো এবং এক পর্যায়ে হযরত ইবরাহিম আ.কে ডেকে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বরং এদের এই প্রধানই তো একাজ করেছে। অতএব কথা বলতে পারলে তাদেরকেই জিজ্ঞেস কর। তারা তখন নিজেদেরকেই অপরাধী মনে করলো এবং অবনত মস্তকে বললো, ইবরাহিম! তুমি তো জান যে, এরা কথা বলে না। হযরত ইবরাহিম আ. তখন বললেন, তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর এবাদত কর, যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদের জন্যে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরই এবাদত কর, ওদের জন্যে। তোমরা কি বোঝ না? কিন্তু বোকার দলেরা এতেও বুঝলো না; বলে উঠলো- ইবরাহিমকে পুড়িয়ে ফেলো, এবং যদি তোমরা কিছু করতে চাও তাহলে তোমাদের দেবতাদের সাহায্য করো। (সূরা আম্বিয়া-৫৮-৬৮)
পাঠক! চিন্তা করুন ওরা বুঝলো যে, তাদের কথিত খোদাগুলো কথা বলতে পারে না এবং চুড়ান্ত অসহায়ত্বের কারণে তারা আক্রান্ত হলে তা প্রতিহতও করতে পারে না। তার পরেও তারা সেগুলোকেই খোদা স্বীকার করে নিয়ে খোদাগুলোর সাহায্য পাওয়ার আশা না করে বরং নিজেরাই খোদাদেরকে সাহায্য করার জন্য ইবরাহিম আ.কে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। তবে ইবরাহিম আ.-এর খোদাতো এক খোদা এবং তিনিই সকল ক্ষমতা ও শক্তির উৎস। তাই তিনি তাদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দিলেন। আগুনকে বাঁধা দিলেন না; বরং আগুনের মধ্যেই ইবরাহিম আ.কে আরামে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। যে আগুনকে নমরুদ খোদা প্রজ্বলিত করলো ইবরাহিম আ.কে জালিয়ে তাদের খোদাগুলোকে সাহায্য করার জন্য সে আগুনকেই উক্ত আগুন, ইবরাহিম আ., নমরুদ ও গোটা দুনিয়ার সকলের খালেক ও মালিক এক আল্লাহ ইবরাহিম আ.-এর জন্য ফুল বাগিচা বানিয়ে আপন কুদরাতের সামান্য একটু কারিশমা দেখিয়ে দিলেন।
মোদ্দা কথা হলো কাউকে খোদার আসনে বসাতে হলে তার মধ্যে সূরা এখলাসে বর্ণিত আলোচ্চ ৪টি গুণের সমাবেস একই সাথে ঘটতে হবে। আর জগতের কোন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, লেখক ও বুদ্ধজীবি একমাত্র মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কারো মধ্যে তা দেখাতে পারেনি আর পারবেও না। অন্যদিকে যদি একাধিক খোদা থাকতো আর সকলেই সমান ক্ষমতার অধিকারী হতো তাহলে খোদাদের ক্ষমতার দাপট ও দ্বন্দে তারাই দিশেহারা হয়ে যেত। মাখলুকের কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়ে ভাবার সুযোগ তাদের হতো না।
যেমন আল্লাহ বলেন- যদি আসমান ও জমিনে আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ থাকতো তাহলে এ দুয়ের নেজাম ধ্বংস হয়ে যেত (সূরা আম্বিয়া— ২৩)।
সুতরাং মানুষের হাতে বানানো অসংখ্য দেব-দেবীকে নয়, দুনিয়াতে জন্মগ্রহণকারী কোন প্রাণিকে নয় এবং চন্দ্র, সূর্য সহ ছেটা-বড় কোন কিছুকেই নয়; বরং এক আল্লাহকেই জানি, তাকেই মানি ও শত জবানে স্লোগান তুলি- সকল গুণে গুণি আমার এক আল্লাহই মহান, জানি-মানি তাকেই তিনি, হৃদয় রাজ্যের ধন। لا اله الا الله তাওহীদেরই বাণী, সব মতবাদ দু’পায় দলে তাওহীদকেই মানি।
খুলনা গেজেট/ এস আই