খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

রথীনের মা

কামরুল ইসলাম

গ্রামের নাম রুপরামপুর। বাংলার গ্রাম বলতে যা বোঝায় তার চেয়েও অজগ্রাম। সেখানে না আছে রুপ, না আছে রাম, লক্ষণ। তবুও নাম তার রুপরামপুর। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন বললে মানায় আর কি!

একদিন গিয়েছিলাম রুপরামপুর গ্রামে বন্ধু খান ফারুখ উদ্দীন, শ্রদ্বেয় উপাধ্যক্ষ শেখ আব্দুল জলীল ও অধ্যাপক আমানউল্লাহ ছিলেন আমার গাড়িতে। রুপরামপুর গ্রামের রূপের আকর্ষণে ঠিক সেখানে যাইনি; গিয়েছিলাম বলাই সাধুর আশ্রমের মেলা দেখতে।

বলাই সাধু দেখতে অত্যন্ত সাধারণ। সাধু বলতে সাধারণত যেমন চেহারা বুঝায় তার চেহারা তেমনটি নয়; বরং তার বিপরীত। গোঁফ দাড়ি নেই। গাঁয়ে গেরুয়া বসন, হাতে একতারা বা ত্রিশূল কিছুই দেখলাম না। চেহারা সাধারণ মানুষের মত। বয়স ৩০/৩৫ বছর হবে। বয়স এবং চেহারা সাধুর মত না হলেও তার ভক্তের অভাব ছিল না। বাৎসরিক মেলার সময় দূর দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্তের ভিড়ে রুপরামপুর গ্রাম মুখরিত হয়ে ওঠে। চারদিকে ধুমধাম পড়ে যায়। তিন দিনব্যাপী ভক্তের আগমনে গ্রামটি মানুষে মানুষে একাকার হয়ে ওঠে। দিন-রাত চলে শুধু রান্না খাওয়া আর প্রসাদ বিতরণে। হাজার হাজার মানুষ সারি সারি বসে খিচুড়ি খায় তিন বেলা, কিন্তু কখনো খাবারে কম পড়ে না।

আরও একটি মজার ব্যাপার হল এত মানুষের ভিড়ে কোথাও এক বিন্দু ময়লা পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক নিত্য কর্ম সম্পাদনের তেমন কোন ভাল ব্যবস্থা না থাকলেও আশপাশের বাতাস তেমন দূষিত হয় না। কোথাও কোন নোংরা দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি। ভক্তরা দল বেঁধে চাল, ডাল, সবজি ফল মূল ইত্যাদি নিয়ে আসে। জমা দেয় বলাই সাধুর মন্দিরের দায়িত্বে থাকা লোকজনের কাছে। মন্দিরটি বিশাল বলা চলে না তবে সুউচ্চ বলতেই হবে। গ্রাম-গঞ্জে এমন উঁচু মন্দির সচারাচর চোখে পড়ে না। গ্রামের লোকজন বলাই সাধুর জমানো মেলা আন্তরিকভাবে উপভোগ করে এবং অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে ও সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আয়োজন সাফল্য মন্ডিত করে তোলে।

সারি সারি পঞ্চান্নটি চুলোয় পঞ্চান্নটি-ডেগে খিচুড়ি পাক হতে থাকে। থালা হাতে সূ-শৃংখলভাবে আগত ভক্তবৃন্দ খিচুড়ির স্বাদ উপভোগ করে। আমার দৃষ্টিতে সার্বিক আয়োজন খুব উপভোগ্য ছিল। শুধু একটি বিষয়ে আপত্তি করেছিলাম- পঞ্চান্নটি চুলোয় রান্না হচ্ছিল কিন্তু বায়ান্নটি ছিল এক লাইনে আর তিনটি ছিল সামান্য দূরে আলাদা লাইনে।

আয়োজকদের মধ্যে আমার শিক্ষক অধ্যাপক নিমাই চন্দ্র মন্ডল স্যারকে তিনটি চুলো আলাদা করার কারণ জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না। তিনি কিছুটা আমতা আমতা করে একপর্যায়ে বললেন- ‘ওটা ব্রা‏হ্মণদের জন্য’। উত্তরটা আমার মনে খটকা লাগালো। ‘ব্রাহ্মণ’ কী এমন জাতি? হোক সে আলাদা শ্রেণীর, কিন্তু চুলোর মধ্যে বিভেদ কেন? মনে মনে ভাবলাম- চুলোয় যাক হিন্দু সমাজের এই শ্রেণীবিভেদ প্রথা। এখনও যদি আমরা সংকীর্ণতা ভুলতে না পারি তবে কি হবে বলাই সাধুর এ মিলনমেলার নিস্ফল আয়োজনে?

রান্না খাওয়ার আয়োজন দেখা শেষ। সকলের অনুরোধে সামান্য আলোচনায় বসতে হল। আলোচনার সময় নিমাই স্যারের মুখে বলাই সাধুর আত্মজীবনী শুনলাম। কিভাবে এত আয়োজনের খরচ সংকুলান করা হয় তার বিশদ বিবরণ পেলাম, এখানে হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের আগমন ঘটে, তাও জানলাম। মাটির উপর হোগলা পাতার চাটোই বিছিয়ে তার উপরে বসে আলোচনা ভালই জমে উঠেছিল। আমারও লাগছিল বেশ।

একসময় শ্রোতার আসন ছেড়ে আমাকে বক্তার আসনে যেতে হলো সকলের অনুরোধে। এ কাজটি আমার মোটেও প্রিয় নয়। প্রবল আপত্তি সত্বেও সর্বজন শ্রদ্ধেয় জলিল স্যার ও নিমাই স্যারের অনুরোধে আপত্তি করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে সম্মান প্রদর্শণপূর্বক দু’চার কথা বলে এবং আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া আর্থিক অনুদানের ঘোষণা দিয়ে আমার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে সভার মাঝখানে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে ছেঁড়া অথচ কুচি দিয়ে ধূতি পরিহিত অবস্থায় দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, ইনিই সেই সম্ভ্রান্ত (?) আলাদা তিন চুলোয় রন্ধনকৃত খিচুড়ি ভক্ষণকারীদের একজন।

মনের খেদ সংবরণ করে ওই কুচি দিয়ে ধুুতি পরা ভদ্রলোকটিকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম আপনার কি সকলের সাথে এক চুলোয় রান্না করা খেতে আপত্তি আছে? যদি থাকে, তবে কেন? চুলোয় দোষ কি? দোষ থাকলে থাকতে পারে চাল, ডাল, তেল, মসলা অথবা রন্ধনকারীর। আমার কথা থামিয়ে দিয়ে নিমাই স্যার বললেন- ‘বাবা, ওসব কথা পরে হবে। তুমি চল খিচুড়ি খাবে’। বলাই সাধু এত সময় চুপচাপ ছিলেন। তিনি দৌঁড়ে এসে বললেন- ‘খিচুড়ি না খেলে আমার অকল্যাণ হবে। আমি নিজের হাতে আপনাদের জন্য খাবার এনেছি’।

খাবার খেতে সাধারণ লাইনে যেতে যেতে দেখলাম সকল বর্ণের হিন্দু নারী পুরুষ গভীর ভক্তি সহকারে খিচুড়ি খাচ্ছে। তাদের বয়ে আনা মালামাল মন্দিরে জমা দিয়ে পাহাড় সমান উচুঁ করে তুলেছে। কিছু কিছু মুসলমান নর-নারীও সেখানে গিয়ে অর্থ ও মালামাল দিচ্ছে। একে অপরের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করে টাকা পয়সা ও জিনিস পত্র দেবার রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। চোখে পড়ার মত দৃশ্য। আজকাল যেখাইে লোকজনের ভিড় দেখি সেখানে হয়ত সরকারি গম, চাল, আটা অথবা কোন এনজিও কর্তৃক দেওয়া সাহায্য নেবার লোকের ঠেলাঠেলির ভীঁড় চোখে পড়ে।

কিন্তু বলাই সাধুর আশ্রমে দেখলাম ঠিক তার বিপরীত। ‘ত্যাগেই আনন্দ, ভোগে নয়’। মানুষের মাঝে এখনও এমন মানসিকতা যে আছে তার উজ্জ্বল নিদর্শন রুপরামপুর গ্রামের বলাই সাধুর আশ্রম। আর এক কলস দুধের মধ্যে এক ফোটা গো-চেনার মতই ওই তিনটি আলাদা চুলা তার পথের কাঁটা। ইতোপূর্বে রূপরামপুর গ্রামে রূপ, রাম, লক্ষন কিছুই ছিলনা। কিন্তু আজ দেখলাম-বলাই সাধুর স্পর্শে সেই অজগ্রামটি রূপ, রস, গন্ধ, রাম-লক্ষন, রহিম-করিমে ভরপুর হয়ে নামের যথার্থতা প্রমাণ করেছে। শুধু ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে ওই তিনটি চুলো।

বলাই সাধুর কাছে যা শিখলাম তারই আলোচনা করতে করতে নিজেই গাড়ীর চালক হয়ে ফিরছিলাম পুর্বের সঙ্গীদের নিয়ে। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আধাঁর রুপরামপুরের প্রকৃত রূপকে গ্রাস করেছে। গাড়ীর হেড লাইটের আলো সেই রূপের কিছু অংশ উপভোগ করার সুযোগ থেকে আমাদের বঞ্চিত করল না। বরং আরও উপভোগ্য করে তুলছিল। আমরা চলেছি আমাদের গন্তব্যের দিকে। ঠিক গ্রামের শেষভাগে এসে এক মহাবিপত্তিতে পড়লাম।

গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাধ্য হয়ে ধীর গতিতে গাড়ী চালাচ্ছিলাম কিন্তু গাড়ীর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে একজন আধাবয়সী মহিলা গাড়ীর সামনে এসে পড়ল। গাড়ীর গতি বেশি না থাকায় অপঘাত ঘটল না, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেলাম। রুপরামপুর গ্রামের পুর্বের চেহারার মত মহিলার চেহারা। বেশ কালো, পরণে না থাকলে নয় এমন এক টুকরা শাড়ী। পেটিকোট ব্লাউজের ধার কখনো ধেরেছে বলে মনে হয় না। মহিলা দুর্ঘটনা থেকে বেচেঁছে এমন মনে হলোনা। অথবা গাড়ীর নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা বলেও বোঝা গেল না।

গাড়ী থামাতেই সে হেড লাইটের আলো থেকে সরে এলো আমার দিকের জালানার পাশে। কোন কথা বলার আগেই ষ্টারিংএ রাখা আমার হাত সজোরে ধরে ফেলে বলল-‘গাড়ী থেকে নামো’। আমি সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। কি করব ভেবে উঠার আগেই জলিল স্যার বললেন- ‘ভয় পাবার কিছুই নেই, ও রথীনের মা। ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন। তুমি গাড়ী সাইড করে নামো’ ।

শরীরের লোমগুলো কাঁটা দেওয়া থেকে স্বাভাবিক হলে গাড়ী সাইড করে নেমে সকলে এক সাথে হাঁটতে লাগলাম। ভয়াবহ রথীনের মা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে জলিল স্যার বললেন “রথীন আমাদের ওয়াসেক আলী শিক্ষা প্রকল্পের সহায়তায় পড়াশুনা করছে। গত বছর সে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেছে। এখন শাহপুর মধুগ্রাম কলেজে পড়ছে। আমরাই খরচ বহন করছি। একদিন ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হবে। তুমি দেখলে হয়তো চিনবে”।

আমি এক প্রকার হাত কড়া পরা আসামীর মত তাদের সাথে হাটছিলাম। রথীন নামটা আমার আবছা আবছা মনে পড়ছিল। ওয়াসেক আলী শিক্ষা প্রকল্প থেকে অনেক ছেলে মেয়েদের সাহায্য দেওয়া হয়। তার অধিকাংশই আমি চিনি না। প্রায় সকলকে চিনেন জলিল স্যার ও ফারুক। কারণ তারাই টাকা পয়সা নিজের হাতে দিয়ে থাকেন। মোটামুটি শিক্ষা প্রকল্পের মূল ব্যক্তি এই দুইজনই ছিলেন। কিছু দূর যাবার পর রথীনের মায়ের বাড়ি পৌঁছালাম।

জসীম উদ্দিনের কবিতার আসমানীদের বাড়ীর চেয়েও ছোট একটি ঘর। তার পাশে মাটি তুলে উঁচু করে ৪/৫ হাত জায়গায় মাছ ধরার পাটা দিয়ে ঘেরা। উপরে ছাউনি নেই। ওটাই রন্না ঘর। আমরা ঘরে ডুকতে গেলে মাথায় দরজায় আঘাত লাগাই নির্ঘাত তাই রথীনের মা চাটই বিছিয়ে ঐ রান্নাঘরে আমাদের বসতে দিল। বসার জায়গা কেমন ছিল তার বর্ণনা না দিয়ে যার অ্যাপায়ন এবং আয়োজনে আমরা সেখানে অংশ নিয়েছিলাম তার আন্তরিকতার কথা না বললেই নয়।

রথীনের মায়ের বাড়িতে পৌঁছানোর পর তার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা তাকে এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে বা হাটতে দেখিনি। শুধু এদিক ওদিক দৌঁড়ায়। কারো বাড়ী থেকে থালা, কারো কাছ থেকে গ্লাস এবং আমার জন্য দু’টি চা চামচ আনতে ভুল করলেন না। একটি কাটা চামচও জোগাড় করতে চেয়েছিল কিšতু এই পাড়ায় কাটা চামচ বস্তুটি তেমন কেউ চেনে না। তাই তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হল। আমার চামচ দিয়ে খাবার বদাভ্যাসটা সে আগে থেকেই জানতো।

অবশেষে রথীনের মা আমাদের সামনে এল কিছুটা ঘর্মাক্ত শরীরে। হাতে দুটি পুরাতন টিনের প্লেট কিন্তু ঝক ঝকে পরিস্কার। একটি প্লেটের মধ্যে কিছু মোয়া, অন্যটিতে মুড়ির মধ্যে বাতাসা মিশানো। সামনে রাখার পর আমরা পরম তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলেছি। কিছু সময় পর দুইটি কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়ে আমাদের সামনে রেখে রথীনের মা নিচে বসে পড়ল। পাশে রাখা তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস দিতে লাগল আমাদের সকলকে। আমি চরম আপত্তি করায় শুধু মাত্র জলিল স্যার এর দিকে বাতাস বয়ে যেতে লাগল। পরম তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলেছি। তার চেয়ে বেশী তৃপ্তি দেখলাম পরিবেশনকারীনির চোখে মুখে। মাতৃত্বের অপরূপ রূপে অকৃত্রিম স্নেহে আবদ্ধ হয়ে রইলাম আমরা সকলেই ।

খাবার প্রায় শেষের দিকে এমন সময় আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগল। প্রশ্ন করব কিনা তা বার বার ভাবছিলাম। পাছে যদি এই মায়ের মনটি কোন কারণে আঘাত পায় তাহলে গোনাহগার হব। শত শত প্রশ্ন যখন আমার মনে জমাট বেধেঁ গেল তখন কোনটা করব আর কোনটা করবনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটা কথা আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন হয়ে উঠলো।

অজগ্রামে একজন অশিক্ষিতা মহিলার মধ্যে শিক্ষার প্রতি এত অনুরাগ কিভাবে জন্মালো। তার ছেলেটিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সে নাকি প্রায়ই জলিল স্যার এবং ফারুকের কাছে যায় বলে ইতোমধ্যে তারা আমাকে জানিয়েছেন। তার বাড়ি থেকে ওয়াসেক আলী শিক্ষা প্রকল্প অফিসে যাওয়া কম কষ্টের কথা নয়। নিশ্চই মহিলার পূর্বপুরুষ, বাবা, ভাই-বোন কেউনা কেউ শিক্ষিত ছিল। তাই শিক্ষার প্রতি তার এত আনুরাগ। শুনেই দেখা যাক তার বাবার বাড়ির পরিচয়। আমি তার পিতৃ পরিচয় জানতে তাকে প্রশ্ন করলাম- আচ্ছা শিক্ষার প্রতি আপনার এত ভালবাসা কেমন করে হল? আপনার বাবা কি করতেন? আপনার বাবার বাড়ি কোথায়?
রথীনের মা- ‘আমার বাবার বাড়ি আন্দুলিয়া গ্রামে’।

আন্দুলিয়া আমার গ্রামের নাম। আমার গ্রামের প্রায় সকল মানুষকে আমি চিনি। হিন্দু পাড়ায় ছাত্র জীবনে আমার বেশ যাতায়াত ছিল আমার সহপাঠিদের বাড়িতে। ভাবলাম মহিলার ভাই বাবা কাউকে না কাউকে অবশ্যই চিনব। মনে মনে গর্ববোধ করলাম। বললাম- আপনার বাবার নাম কি?

রথীনের মা সরাসরি উত্তর দিলেন- ‘আমার বাবার নাম- কামরুল ইসলাম’। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আমি বাকহীন হয়ে গেলাম। অবশিষ্ট মুড়ি বাতাসা মুখে দিতে গিয়ে হাতে এবং দাঁতে কোথাও শক্তি পেলাম না। একবার মহিলার দিকে আর একবার অন্যদের মুখের দিকে তাকাতে থাকলাম। কিছু সময় বসে থাকার পর সকলে আমার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করে তারাও চুপ চাপ হয়ে রইল। আমার চোখের কোনায় আনন্দ অশ্রু জমা হতে হতে এক সময় গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। নিজেকে সংবরণ করতে তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়াই সমীচিন মনে হওয়ায় দেরি না করে বিদায় নিলাম। রথিনের মা আবারও কেরোসিনের ল্যাম্প হাতে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।

রাস্তায় যেতে যেতে জলিল স্যার আর ফারুকের কাছে রথীনের মায়ের আরও অনেক কাহিনী শুনলাম। এর আগে বহুবার সে বাড়ি থেকে শাঁক-পাতা, শাপলা, থানকুনি পাতা জোগাড় করে জলিল স্যারকে দিয়ে এসেছে। স্যারের স্ত্রী এগুলো পছন্দ করেন তাই তাকে ওসব জোগাড় করে দিয়ে নিজেও তৃপ্তি পেত এবং রথীনের পড়াশুনার খরচ যাতে বন্ধ না হয় সে পথও পরিস্কার রাখতো। জলিল স্যার নিষেধ করেও বন্ধ রাখতে পারেননি। মহিলা মনে কষ্ট পাবে ভেবে তিনি জোর দিয়ে কিছু বলেন না। এর আগে জলিল স্যার ও ফারুক যতবার একই গ্রামের প্রকাশ নামের ছেলেটির পড়াশুনার খবর নিতে তাদের বাড়িতে যেতেন ঠিক ততবারই রথীনের মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের ধরে বাড়িতে নিয়ে যেত।

অনেক দিন পর, আমি তখন চাকুরির সুবাদে ঢাকায় কর্মরত। ইতোমধ্যে রথীন ইংরেজী সাহিত্যে অনার্সসহ এমএ পাশ করেছে। ঢাকায় এসেছে চাকুরির খোঁজে। আসার সময় ওর মা বলে দিয়েছে সরাসরি আমার কাছে আসতে। মায়ের কথামত আমার কাছে হাজির হল। সব কথা জেনে আমি মনে মনে গর্বিত হলাম। চাকুরি জোগাড় করে দিতে বেশী বেগ পেতে হল না। রথীন যোগ্য ছেলে। তাছাড়া মাসখানেক আগে আমার এক স্নেহের ছোট ভাই তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন ভাল ইংলিশ লেকচারার আবশ্যক বলে জানিয়েছিল। রথীনকে ওই পদে যোগ্য মনে করে সরাসরি তার কাছে পাঠালাম। রথীন তার যোগ্যতাবলে ওইদিনই সেখানে নিয়োগ পত্র পেয়ে গেল। মাসিক বেতনও মোটামুটি ভাল। প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্নেহের ছোট ভাই গাজী আব্দুল ছালাম আমাকে মোবাইলে জানালো উপযুক্ত শিক্ষক পাঠিয়েছেন। এলাকায় এধরণের যোগ্য ছেলে থাকলে আরো পাঠাতে আনুরোধ করলো।

রথীন শিক্ষকতার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের একটি আবাসিক ভবনের হাউস টিউটরের দায়িত্ব পেয়ে গেল। তাতে কিছু অতিরিক্ত উপার্জনসহ থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা হলো। চাকরি পেয়ে রথীন খুশী হয়ে মায়ের জন্য প্রায়ই এটা ওটা কিনে বাড়ি পাঠাতে শুরু করেছে। আমাকে রথিন ও তার মা প্রায় সব কিছু জানায়।

এক দিন গ্রাম থেকে ফারুক মোবাইল করে বললেন-‘রথীনের মা তোর সাথে কথা বলবে’। আমি ভাবলাম- কি ব্যাপার, কথা বলতে আবার ফারুকের সুপারিশ কেন! কোন খারাপ সংবাদ না তো! ভয়ে ভয়ে ফোনটা তাকে দিতে বললাম। রথীনের মা বললে- ‘তুমি আর বাধাঁ দিয়ে না। ওরে যাতি দেও’। আমি কিছুই বুঝলাম না। কাকে বাধাঁ দেব এবং কোথায় যেতে দেব-তা না বুঝে বললাম- ঠিক বুঝতে পারছিনা, আমাকে একটু খুলে বলুন।

রথীনের মা- ‘তোমার ভাইডি নাকি কনে যাতি চাচ্ছে। ওর চাকরির দরকার নেই। আমি ওর টাকা খাতি চাইনে। তুমি ওরে যাতি দেও’। ভাবলাম রথীন ওর মায়ের মনে আঘাত দিয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে ওকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।

তখনই ছালামের কাছে ফোন করে রথীনের মোবাইল নম্বর নিয়ে সাথে সাথে ফোন করলাম। রথীন-‘দাদা কেমন আছেন? মা আপনাকে কিছু বলেছে? একটা সু-সংবাদ আছে, তাই মায়ের মুখ থেকে আপনার কাছে দিতে চেয়েছি। আপনি খুশী হয়েছেন’?

আমি বললাম- কি সংবাদ?

রথীন- ‘ইন্ডিয়ান গভঃমেন্টের একটা বৃত্তি পেয়েছি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গেলে আরও বড় কিছু হতে পারবো। আপনি চাকুরিটা দিয়েছেন, এত তাড়াতাড়ি চাকরি ছাড়ার কথা আপনাকে বা ছালাম স্যারকে কেমন করে বলি। তাই মাকে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে জানাতে, আপনি অনুমতি দিলে দিল্লী যাব এবং ছালাম স্যারকে একটু বলে দিলে ভাল হয়।’

ওর কথা শুনার পর আমার অহংকার আরো বেড়ে গেল। ছালামকে জানালে সেও খুশি হলো এবং বলল সে যদি উচ্চ শিক্ষা শেষে দিল্লী থেকে ফিরে আবার আমার প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে তাহলে তাকে আবার নেওয়া হবে ।

রথীন এখনো দিল্লীতে। আর দেশে ফিরবে কিনা জানিনা। আমি আছি আফ্রিকার সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্ব শান্তি স্থাপনে কর্মরত। এক বছরের চুক্তিতে এখানে এসেছি। সবে মাত্র তিন মাস পার হয়েছে। রথীনের মায়ের সাথে প্রথম যেদিন আমার পরিচয় হয়েছিল সেদিন আমার মা বেচেঁ ছিলেন। আমার মা কয়েক বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। মায়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বিশেষ করে আফ্রিকার মরুভুমিতে বসে যখন একাকী সময় কাটাই তখন বেশি বেশি মনে পড়ে। মায়ের কথা মনে হতেই রথীনের মাকেও মনে হয়। সে এখনো বেঁচে আছে। জলিল স্যার ও ফারুকের কাছ থেকে আমার খবর নেয় বলে শুনেছি। আমি তার খবর রাখিনা কিন্তু সে আমার খবর ঠিকই রাখে। ‘মা’ বলে কথা! শাস্ত্রে বলে ‘কু-পুত্র যদ্যপী হয়, কু-মাতা কখনো নয়’!

আমি কু-পূত্র না সু-পুত্র তা জানিনা। আমার মাকে যতটা মনে করি ততটা রথীনের মাকে মনে করি কিনা অংকের হিসেবে তা মিলিয়ে বলতে পারব না। তবে একথা হলফ্ করে বলতে পারি যে, আমার কানে প্রায়ই একটি কথা এখনো মাঝে মাঝে শুনতে পাই। রথীনের মায়ের সেই নিষ্পাপ সহজ সরল উক্তি। ‘‘আমার বাবার নাম কামরুল ইসলাম”। আফ্রিকার মরুভূমিতে, ঢাকা শহরে, দেশের অন্য কোথাও যত কাজে ব্যস্ত থাকি না কেন, আমার কানে মাঝে মাঝে ভেসে আসে সেই একটি কথা ‘‘আমার বাবার নাম কামরুল ইসলাম”।

রথীনের মায়ের সেই উক্তি আমি আমরণ শুনতে পাবো। আমার প্রয়াত মায়ের স্থানে তাকে স্থান দিয়ে মায়ের অভাব পুরণ করার চেষ্টা করে যাব আজীবন। শুধু রথীনের মায়ের বাবার নাম কোন দিন ‘কামরুল ইসলাম’ হবে না জেনেও মাঝে মাঝে ওই সুমধুর মিথ্যা কথাটি শুনতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকব।

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!