খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতার নেপথ্যে অর্থনৈতিক সুবিধা

নূরুল ইসলাম লাবলু

মে মাসের শেষদিকে, খবর বের হলো, পেন্টাগন প্রধান বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও চীনের সমকক্ষ কোনো সামরিক নেতাদের কারো সাথেই কথা বলার সুযোগ করে উঠতে পারেননি (Pentagon chief unable to talk to Chinese military leaders despite repeated attempts, রয়টার; মে ২১, ২০২১)।

রীতিমত হইচই পড়া খবর, সামরিক শক্তিতে প্রধান যে দেশ, সেই দেশের প্রধান সামরিক কর্মকর্তা বার বার চেষ্টা করছেন দ্বিতীয় শক্তিধর দেশের একজন সামরিক নেতার সাথে ফোনে কথা বলতে, কিন্ত পারছেন না। বিষয়টি ভাবনার উদ্রেক করে না?

এর সাথে সাথে, কয়েকদিনের মধ্যেই, আমরা দেখতে পেলাম, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নুতন করে তদন্তের আহবান জানানোর খবর Biden Calls for Intelligence Reports on Origins of Covid 19, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল; মে ২৭, ২০২১)। পাল্লা ও রেষারেষি ছাড়া, বলুনতো, এটা আর কি হতে পারে?

আপনাদের মনে থাকার কথা, গত বছর, এই বিতর্ক প্রথম দেখা দিয়েছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথার সূত্র ধরে। তারপর, তা জটিল হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী মরিসনের এ বিষয়ে তদন্ত আহবানের পর।

কিন্ত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যখন করোনাভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানের চেয়ে তাঁকে নির্মূল করাটা জরুরী বলেছিলেন, তখন, এটি আর বেশীদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

তাছাড়া, গতবছর, সেটা ছিল এমন এক সময় – বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পাত্তা দিতেন না, তার কথাবার্তাকে হিউমজিক্যাল লিডারের মূহুর্তের তাড়নাজাত সংলাপ বলে মনে করতেন। অধিকন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দলও তখন উহান পরিদর্শন করেছিলেন ও ভাইরাসটিকে প্রাকৃতিক বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা তাহলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী চীন যেখানে ভাইরাসটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছিল, সেখানে গতবছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে হালকা করে দেখছিল।

স্মরণ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রমণ রোগ ও অতিমারি সংক্রান্ত বিষয়ের তৎকালীন প্রধান Anthony Fauci তখন এই ভাইরাসটি সম্পর্কে বলেছিলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ হল ঠাণ্ডাসর্দীর চেয়ে জাস্ট সামান্য বেশীকিছু।

একথা তিনি বলেছিলেন, ASM Biothreats এর বাৎসরিক কনফারেন্সের প্লেনারি সেশনে। তাঁর আলোচিত সেই জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যের শিরোনাম ছিল Coronavirus Infections: More than Just the Common Cold, যার সারসংক্ষেপ আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির জানুয়ারি ৩০, ২০২০ সংখায় প্রকাশিত হয়েছিল।

যেমন ঘোড়া, তেমনি চার চাবুক

গার্ডিয়ান পত্রিকায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করোনা সংক্রান্ত হালকাধাচের বক্তব্যবিবৃতি নিয়ে একটি টাইমলাইনও প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল, উধাও হয়ে যাবে এটা : করোনাভাইরাস নিয়ে যে ভুল-ভাল-তথ্য ট্রাম্প ছড়িয়েছিলেন তার সময়রেখা (It will disappear : the disinformation Trump spread about the coronavirus – timeline, দ্য গার্ডিয়ান এপ্রিল ১৪, ২০২০)

অতঃপর, নির্বাচন নিয়ে ২০২০ বছরজুড়ে, দু’দলই দৌড়ের উপর ছিল, করোনাভাইরাসের চেয়ে অন্যকিছু প্রায়োরিটি পেয়েছিল, ফলে তখন আর বিষয়টি আগায়নি। কিন্তু এবার আবার শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যথারিতি চীনও নিজের ডিফেন্স নিচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুখপত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, তাদের কাছে যখন এরকম একটা তদন্ত চাওয়া হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রও তাহলে চীনের মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সহযোগীতা করে নিজের দেশেও করোনা ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানি একটা তদন্ত শুরু করুক। যে তদন্ত হবে বোধগম্য, স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক।

তিনি বলেছেন, “দেখুন, গতবছর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই মর্মে উপসংহারে এসেছিল যে, কোভিড ১৯ অতিমারি যে ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট, তা কিছুতেই ল্যাবলিক থেকে বিস্তারলাভ করেনি। তদন্ত বিষয়ে হুর বিশেষজ্ঞ দল বহুবার চীনের সহযোগীতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশংসা করেছেন। কিন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মানুষ সে বিষয়ে অন্ধ।

এতে একটা জিনিস পরিষ্কার

“যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতা ও সত্যকে কেয়ার করে না। তারা অতিমারির উৎস অনুসন্ধানের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণারও ধার ধারে না। তারা চীনকে বলির পাঠা বানাতে চায়। অতিমারির আড়ালে খেলতে চায় একটি রাজনৈতিক খেলা।”

“জীবন ও বিজ্ঞানের প্রতি এটা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন। অতিমারি নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈশ্বিক যে প্রচেষ্টা চলছে, তার জন্য এটা ক্ষতিকর”।

ঝাও এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির ইতিহাস তুলে ধরে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, তাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যবিদায়ী সেক্রেটারি অফ স্টেইট মাইক পম্পেওকে নিয়ে একটি গল্প বলেন।

মাইক পম্পেও একসময় সিআইএর পরিচালক ছিলেন। একদিন তিনি বলেছিলেন, আমি সিআইএর পরিচালক ছিলাম। আমরা মিথ্যা কথা বলেছি। প্রতারণা করেছি। চুরি করেছি। গোটা বিষয়ে আমাদের অনেক প্রশিক্ষণ নেয়া আছে।

ঝাও প্রশ্ন করেন, “এখন আপনারা বলুন, এরকম একটা ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিকে মানুষ বিশ্বাস করবে কেন”?

যেখানে ৩৩ মিলিয়ন মানুষ কোভিডে আক্রান্ত, মারা গেছে ৬ লাখের মত। কেন সেখানে তারা নিজেদের দিকে না তাকিয়ে উল্টো আমাদেরকে বলির পাঠা করতে চাইছে? দেখুন, আমার তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, বলুনতো, আপনারা আসলে কি চাইছেন? কোথায় আপনাদের বিবেক?

ঝাও কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “আপনাদের ফোর্ট ডেট্রিক ল্যাব এবং অন্যান্য ওভারসিজ ল্যাবগুলিতে কি পরিমাণ গোপনীয়তা লুকিয়ে আছে যা মানুষ জানেনা?

২০১৯ সালে ভার্জিনিয়ার উত্তরাঞ্চলে রেসপিরেটরি যে ডিজিজটা দেখা দিয়েছিল, বলবেন, সে বিষয়ে সত্যটা কি? বা উইসকনসিনে ই-সিগারেট থেকে ফুসফুসের যে রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটার কাহিনী?

বিশ্ববাসিকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলতে হবে (US owes the world an explanation on Fort Detrick lab secrets: Chinese FM, গ্লোবাল টাইমস; মে ২৭, ২০২১)।

যুক্তরাষ্ট্রকি তা কোনোদিন ব্যাখা করবে মানুষের কাছে? করুক আর না করুক, প্রকৃত সত্য একদিন আলোর মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আপাতত, তাত্ত্বিক মানুষেরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, জিজ্ঞাসা করছেন, এর মানে কি, কেন যুক্তরাষ্ট্র এমন করছে?

এটা হলো post-truth politics।

মানুষ যেখানে ভিষণভাবে বিভক্ত, একদল যেখানে অন্যদলের মানুষকে চরমভাবে অবিশ্বাস করে, যাদের মধ্যে আইডেন্টিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেখানে মানুষের মোহভঙ্গের বিষয়টি post-truth politics দ্বারা প্রকাশিত হয়। মূলে থাকে কন্সপিরেসি থিওরি ও বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা। দেখুন U.S. obsession over WIV theory reveals post-truth culture, সিজিটিএন; মে ২৮, ২০২১। কিন্তু এটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আমার কাছে মনে হয়, নগদে বিষয়টি বাণিজ্য।

ল্যাবলিকের তত্ত্ব এবার যে বেশ জোরালোভাবে সামনে আসছে, অন্যতম কারণ হলো চীনের উপর প্রেসার তৈরি করা ও প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ আদায়ের জন্য একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।

এটা হলো চীনের বাজার থেকে বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের স্ট্রাটেজি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কার্যকর কৌশল শানানো।

কারণ, একদিকে এইরকম রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে, অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক প্রধান ক্যাথরিন টাইয়ের সাথে কিন্ত কথা হয়ে যাচ্ছে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হি এর। জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পর এই প্রথম বাণিজ্য বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে কথা হলো (US-China trade war: top negotiators hold ‘candid and constructive’ talks, first of Joe Biden presidency, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ; মে ২৭, ২০২১)

তার মানে? মানে যে যাই বলুক, আজকালকার বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিচক্ষণ রাজনীতির প্রধান নিয়ামক সম্ভবত অর্থনীতি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!