খুলনা, বাংলাদেশ | ২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেপ্তার
বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব

মোংলায় বিদেশী জাহাজ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা চোরাকারবারী চক্র বেপরোয়া

হামিম হোসেন, মোংলা

মোংলা বন্দরের বিদেশী জাহাজ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ চোরাচালানী চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ চক্রের শক্তিশালী সদস্যরা বন্দরে আগত বিভিন্ন বিদেশী জাহাজ থেকে নদী পথে জ্বালানী তেল, মবিল, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ সহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিষপত্র অবাধে পাচার ও লুটপাট করে আনছে। কাষ্টমস, পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বন্দর প্রহরীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাকারবারী চক্রের সদস্যরা দিনে রাতে সমানে দেদারছে এসব পণ্য পাচার ও লুটপাট করলেও অবৈধ পণ্য আটকের ঘটনা ঘটছে তুলনামূলক অনেকটাই কম। এতে করে সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরের বৈধ ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় মারাত্মক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন।

বন্দরের জাহাজের চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত ও একাধিক আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, মোংলা শহরের রিজেকশন গলি, বাইদ্যা পাড়া কানাই নগর, কুমারখারী, কলেজ মোড় জয় বাংলা, মাদ্রসা রোড়, মালগাজি,রাতারাতি কলোনী, দিগরাজ, বাজুয়া, লাউডোব, চিলা বাজার, বানী শান্তা বাজার, মাছ মারা, নারকেল তলা, জয়মনীর ঘোলসহ বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় বিদেশী জাহাজ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠেছে শক্তিশালী চোরাচালান চক্র। এসব চক্রের অসাধু সদস্যরা ট্রলার ও নৌকা যোগে পশুর চ্যানেলে অবস্থানরত বিদেশী জাহাজের নাবিকদের সাথে আঁতাত করে চোরাই পথে জ্বালানী তেল, মবিল, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, রং, ব্যারেল, সোলার প্যানেল, গ্যাসের চুলা, নানা ধরনের লোহা, ঢাল কাঠ, ওয়ার রোপ, হাসিল (জাহাজ বাঁধার বড় রশি), ইলেকট্রনিক্স পণ্য, নানা ধরনের মাদকসহ (বিদেশী হুইস্কি, বিয়ার, হেরোইন, ইয়াবা প্রভৃতি লোকালয়ে পাচার করে আনে। শুধু তাই নয়, বিদেশী জাহাজ সমূহে কুকুর-বিড়াল ও শুকুর পাচার করে চোরা গ্রুপের সদস্যরা। এতে একদিকে সমুদ্র এ বন্দরের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। অপর দিকে মোটা অংকের টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

অন্যদিকে বন্দরের বৈধ ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় মার খেয়ে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বিষয় মোংলা বন্দর কাস্টম ভ্যান্ডার এ্যাসোশিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোতালেব জানান, মোংলা বন্দরের কাস্টমের অধিনস্থ প্রায় ৬০টি ভ্যান্ডার লাইসেন্স রয়েছে। কাষ্টমসকে শুল্ক-রাজস্ব দিয়ে ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে বৈধ পথে স্ক্র্যাপ (পুরাতন মালামাল) ব্যবসা করছেন। কিন্তু সম্প্রতি বন্দর কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা স্থানীয় চোরা গ্রুপের দাপটে বন্দরের এ সকল বৈধ স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া বিদেশী নাবিকদের হয়রানী ও জিম্মি করে নাগদ অর্থ কড়িসহ জাহাজের বিভিন্ন মালামাল লুটপাট করে থাকে এ চক্রটি। এতে বন্দরের সুনামও নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে বৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ তৈরি হলে এ খাতে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব পাবে বলে জানান তিনি।

গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কোস্টগার্ড মোংলা (পশ্চিম) জোনের সদস্যরা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বিদেশী জাহাজ থেকে চোরাচালানী চক্রের পাচার করে আনা দু’টি বড় ধরনের চোরাচালানের চালান আটক করতে সক্ষম হয়েছে। এ সময় কোস্টগার্ডের হাতে উদ্ধার অবৈধ পণ্য ও আটক তিন চোরাচালানীকে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর (রোববার) ভোর রাতে বন্দরের প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে গড়ে ওঠা এ চক্রের শক্তিশালী সদস্যরা বন্দরে আগত একটি বিদেশী জাহাজ থেকে নদী পথে নৌযান যোগে ৩৯টি ড্রামে ১৯৫০ লিটার লুব ওয়েল (জ্বালানী তেল) ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, সোলার প্যানেল, ব্যাটারি, গ্যাসের চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডারসহ কয়েক লাখ টাকার বিভিন্ন মূল্যবান জিনিষপত্র অবাধে পাচার ও লুটপাট করে আনে। গোপন সূত্রে এ খবর পেয়ে কোস্টগার্ড মোংলা (পশ্চিম) জোনের সদস্যরা পশুর নদীর জয়মনী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চোরাচালানী চক্রের নৌযান বোঝাই পাচার করে আনা চোরাচালানের এসব পণ্যসহ ৩ চোরাচালানীকে আটক করে রোববার রাতে মোংলা থানায় হস্তান্তর করে। আটককৃত চোরাকারবারীরা হলেন, চাদঁপাই ইউনিয়নের কানাইনগর এলাকার বুলু খাঁ’র ছেলে নিয়ামুল খাঁ, পৌরসভা ৭নং ওয়ার্ডের জয় বাংলা সড়কের রফিকুল ইসলাম ও একই এলাকার মৃত মিনহাজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে হারুন হাওলাদার।

মোংলা থানার ওসি ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, আটক তিন চোরাচালানীর বিরুদ্ধে সোমবার ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের শেষে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এদিকে আটক চোরাকারবারী চক্রের স্বজনদের সোমবার সকালে মোংলা থানা চত্বরে ভীড় করতে দেখা গেছে।

এর আগে গত ১৭ আগস্ট রাতে পশুর নদীর হারবাড়িয়া জোংড়ার খাল এলাকার জাহাজ থেকে চোরাই পথে পাচারের সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় ৫০ ব্যারেল ডিজেল তেল আটক করে। এ সময় চোরাচালানী চক্র কোস্ট গার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে তেল বোঝাই ট্রলারটি নদীতে ডুবিয়ে দেয়াসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরে জব্দকৃত তেল মোংলা থানায় হস্তান্তর করা হয়। আটক চোরাচালানীদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে কোস্টগার্ডের পশ্চিম (মোংলা) জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার শাহরিয়ার পারভেজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোস্ট গার্ড এর এখতিয়ারভুক্ত এলাকাসমূহে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চোরাচালানেও কোস্ট গার্ড জিরো টলারে›স নীতি অবল¤¦ন করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা লে. কমান্ডার নুর মুহাম্মদ এ ব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, বন্দরের চ্যানেল তথা নৌ পথের দায়িত্ব কোস্ট গার্ডের। আর বন্দরের স্থল ভাগের দায়িত্ব পালন করছে বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীদের। এ ক্ষেত্রে নদী পথের দায়িত্ব বন্দরের সাথে সমন্বয় করে কোস্টগার্ড তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে চলেছে।

অপরদিকে মোংলা থানার ওসি ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, বন্দর এলাকায় চোরাচালান বন্ধে পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছে। কোস্টগার্ডের হাতে জব্দ চোরাচালান পণ্যের সাথে জড়িতদের নেপথ্যের প্রভাবশালী মহলকে পুলিশ খুঁজে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!