(১) মৃত ব্যক্তির জন্য ঈসালে সাওয়াবঃ
‘ঈসালে সাওয়াব’ ফারসী শব্দ। আরবীতে হবে ‘ঈসালুস সাওয়াব’ (তবে এক্ষেত্রে আরবীতে অন্য শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয় যেমন ‘ইহদাউস সাওয়াব’।) এর আভিধানিক অর্থ হল সাওয়াব পৌঁছানো। পরিভাষায় ঈসালে সাওয়াব বলা হয় কোনো নেক আমল করে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিকে দান করা। কষ্টার্জিত আমলের সাওয়াব যে কাউকে দান করা হয় না। এ সাধারণত তাকেই দান করা হয় যার প্রতি মহব্বত ও আন্তরিকতা আছে। প্রিয়জন আখেরাতের পথিক হয়ে গেলে তার জন্য এমন কিছু করা মানুষের স্বভাবজাত আগ্রহ, যা তার শান্তি-সফলতার পক্ষে সহায়ক হবে, তার জন্য আল্লাহর রহমত ও করুণার উপায় হবে। ফলে তিনি তার গোনাহ মাফ করে দিবেন, মর্যাদা উঁচু করবেন এবং সুখে-শান্তিতে ভরিয়ে তুলবেন। এই মহব্বতের একটি অনুষঙ্গ হল আত্মীয়তা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ঈমান, সৎকর্ম ও সদ্ব্যবহার। এজন্য পিতা-মাতা, দাদা-দাদী প্রমুখের জন্য যেমন ঈসালে সওয়াব করা হয়, তেমনি উস্তাদ-মুরব্বী, আলেম-উলামা, ওলী-বুযুর্গ ও নবী-রাসূলগণের জন্যও করা হয়; বরং ঈমান, সৎকর্ম ও সদাচারে যারা অগ্রগামী তাদের জন্যই বেশি ঈসালে সওয়াব করা হয়। আর তাতে সহযোগিতার চেয়ে সৌভাগ্য ও সাআদাত অর্জনের মনোভাবই কাজ করে বেশি। কোনো নেক লোকের সঙ্গে ঈসালে সওয়াবের সম্পৃক্ততাও সৌভাগ্য বৈকি? এ কারণে সবার গুরুত্ব ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ঈমান, সৎকর্ম ও উত্তম আচার-ব্যবহারে অগ্রগামিতা এবং তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
(২) ঈসালে সাওয়াবের কিছু উপকারী পদ্ধতিঃ
(হজ্ব)
হজ্ব ইসলামের এক প্রোজ্জ্বল শিআর এবং অত্যন্ত গভীর ও হৃদয়গ্রাহী ইবাদত। এর মধ্য দিয়ে বান্দা আর প্রতিপালকের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্কের চর্চা হয় তা অতুলনীয়। সেই সাথে এটা অনেক পুণ্যময় আমলও বটে। এক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন,আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। জিজ্ঞেস করা হল, তারপর কী? বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হল,তারপর কী? বললেন, মাবরূর হজ্ব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫১৯
হজ্বের ঈসালে সওয়াব করা জায়েয। এটা একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করল,…আমার মা হজ্ব না করে ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারব? তিনি বললেন,(হাঁ), তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্ব কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস১১৪৯
এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, হজ্ব মাইয়িতের উপকারে আসবে এবং এর সওয়াব তার কাছে পৌঁছবে। এখানে মাইয়িতের জন্য হজ্ব করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬হি.) লেখেন,
..الدعاء والصدقة والحج فإنها تصلبالإجماع
দুআ, সদকা ও হজ্বের সওয়াব সর্বসম্মতিক্রমে মাইয়িতের কাছে পৌঁছে। -শরহু সহীহ মুসলিম ১/৯০
(উমরা)
উমরা খুবই সওয়াবের কাজ। এক হাদীসে আছে, তোমরা হজ্ব ও উমরা পরপর একত্রে আদায় করো। এ দুটো দারিদ্র ও গোনাহকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লাদূর করে দেয়। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৮১০
অন্য এক হাদীসে আছে, এক উমরা থেকে আরেক উমরা মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৯
উমরা করেও ঈসালে সওয়াব করা জায়েয। আবু রাযীন উকায়লী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা খুবই বৃদ্ধ। তিনি হজ্ব, উমরা এমনকি সফর করতেও সক্ষম নন। নবীজী বললেন, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্ব ও উমরা করো। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৯৩০
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, মাযূরের পক্ষ থেকে নায়েব হিসেবে উমরা করা জায়েয। সুতরাং নিজে উমরা করে মাইয়িতকে সওয়াব পৌঁছানোও জায়েয হবে। কারণ ‘নিয়াবতে’র চেয়ে ঈসালে সওয়াব হালকা।
(কুরবানী)
কুরবানী ইসলামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিআর ও ইবাদত এবং আল্লাহর জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের এক অনুপম অনুষঙ্গ। সামর্থ্যবানের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। হাদীসে এর প্রতি সবিশেষ উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা-জীবনে প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, কুরবানীর ঈসালে সওয়াব করা জায়েয।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর জন্য কালো পা, কালো পেট ও কালো ভ্রু বিশিষ্ট দুম্বা আনার নির্দেশ দিলেন। আনা হলে তিনি আয়েশা রা.-কে বললেন, একটি ছুরি এনে পাথরে ঘষে ধারালো কর। তিনি তা-ই করলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাকে শুইয়ে যবাহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন এবং বললেন,
باسم الله، اللهم تقبل من محمد وآل محمد، ومن أمة محمد
‘আল্লাহর নামে যবাহ করছি। হে আল্লাহ! আপনি তা কবুল করুন মুহাম্মদ ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে।’ তারপর কুরবানী করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭
আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানী করেছেন এবং বলেছেন, এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার যে সকল উম্মত কুরবানী করতে অক্ষম তাদের পক্ষ থেকে। -মুসনাদে আহমাদ,হাদীস ১১০৫১
এ হাদীস এ আমরা লক্ষ করেছি যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য কুরবানী করেছেন এবং এতে নিজ পরিবার ও উম্মতের মধ্যে যারা কুরবানী করতে অক্ষম তাদেরকে অংশীদার করেছেন। বহু ফকীহ ও হাদীস ব্যাখ্যাকার বলেছেন যে, এখানে তাদেরকে সওয়াবের মধ্যে শরীক করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাদেরকে কুরবানীর সওয়াব পৌঁছানো হয়েছে।
লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ও সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এমএম