প্রিয় নবীজি সা. এর জন্মের অনেক আগের কথা। বনি ইসরাইল গোত্রের এক যুবক। নাম তার জুরাইজ। বড় সাদা-মাঠা বালক। বেশভ‚ষা, চলাফরায় খুব নম্র প্রকৃতির। লোকালয়ের কলহ, চিৎকার তার মোটেই পছন্দ নয়। একাকী নিরিবিলি থাকাটাই তার কাছে বেশী স্বাচ্ছন্দের।
কিন্তু কদিন হল জুরাইজ একদম জনবিচ্ছিন্ন। কোথাও তার দেখা নেই। এমনকি বাড়িতেও ফিরছে না। শোনা যাচ্ছে সে নাকি জঙ্গলে একটি নিরব খুপড়িতে অবস্থান নিয়েছে। নশ^র পৃথিবীর ব্যস্ততা থেকে সে একটু মুক্তি পেতে চায়। মহান প্রভ‚র একান্ত সান্নিধ্য অর্জনে ধন্য হতে চায়।
কলিজার টুকরা সন্তানের জন্য মায়ের মনটা ব্যকুল হয়ে উঠলো। না খাওয়া, না দাওয়া ছেলেটি কোথায় কিভাবে পড়ে আছে ভেবে মায়ের মন ব্যকুল হয়ে উঠল। জুরাইজের মা খুঁজতে খুঁজতে তাকে জঙ্গলের এক খুপড়িতে আবিষ্কার করল। না আছে আলো-বাতাস আর না আছে বিছনাপত্র। ডাল পালার ছাউনি বেষ্টিত এক জীর্ণ কুটিরে নিজের প্রাণের ধন এভাবে পড়ে আছে! দেখেই মায়ের ভিতরটা ডুকরে কেদে উঠলো।
মা বললেন চল বাবা, বাড়িতে চল। কিন্তু জুরাইজ কিছুতেই বাড়িতে ফিরতে রাজি নয়। মা নিজের একাকীত্ব ও অপারগতার কথা বলেও দোহাই দিলেন। কিন্তু জুরাইজ তাতেও কর্ণপাত করলো না। বললো, হে আল্লাহ, একদিকে আমার মা আর অপরদিকে আমার ইবাদত। (আমি কোনটি বেছে নিব…!) এই বলেই সে নামাজে দাড়িয়ে গেল। অগত্যা তার মা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে ফিরে গেলেন।
কিন্তু মায়ের মন বলে কথা। থেকে থেকে তার বিষন্নতা আরো বেড়ে চলল। পরের দিন তিনি আবার আসলেন। জুরাইজকে বললেন বাবা চল আমার সাথে। বাড়িতে আমি একা মানুষ। বৃদ্ধ বয়েসে তুই ছাড়া আমার দেখাশুনার কে আছে? কিন্তু জুরাজের চিন্তার জগতে ভিন্ন কিছু ভর করে বসে আছে। জুরাইজ বুঝতে পারল না যে, মায়ের সেবার গুরুত্ব নফল নামাজের চেয়েও বহুগুন বেশী। সে বললো, হে আল্লাহ, একদিকে আমার মা আর অপরদিকে আমার ইবাদত। (আমি কোনটি বেছে নিব…!) আজকেও সে নামাজে মনোনিবেশ করল। আর তার মা অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে ফিরে গেলেন।
পরের দিনও একই ঘটনা। জুরাইজ তার নির্বুদ্ধিতার উপর অটল। সে ভাবছে আমিতো আল্লাহর ইবাদতের মত মহাৎ কর্মে মশগুল। মায়ের সেবার গুরুত্ব এর কাছে কিছু নয়। সুতরাং আজকেও সে মায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল।
নিজের ছেলের এহেন আচরণে জুরাইজের মা খুব ব্যথিত হলেন। ধর্যের চরম সীমা উপেক্ষা করেছে ছেলে। মায়ের অনুরোধ এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারলো! নিজের অজান্তাই মুখ থেকে খুব কঠিন কথা বলে ফেললেন। ছেলেকে বদ দোয়া করলেন। আর মায়ের বদদোয়াতো অবশ্যম্ভবী। হে আল্লাহ, কোন নষ্টা মেয়ের চক্রান্তের শিকার না হয়ে যেন ওর মৃত্যু না হয়…!
ব্যাস, মায়ের বদদোয়ার ফল ফলতে বেশী সময় লাগলো না। এক কান দুই কান করে জুরাইজ আর তার মায়ের ঘটনা সারা এলাকায় জানাজানি হয়ে গেল। সব জায়গায় এখন একটাই কথা। কি ছেলেরে বাবা, নিজের মাকে এভাবে ফেলে রেখে জঙ্গলে গিয়ে বৈরাগী সেজেছে। এটা আবার কেমন দরবেশ। ইত্যাদী।
শুধু কি তাই? তারা জুরাইজকে নিয়েও গভীর ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি নিল। তাকে একটু সায়েস্তা করা করা দরকার। যে করেই হোক তার মুখে চুনকালী দিতেই হবে। কিন্তু কি করা যায়…?
সিদ্ধান্ত হল কোন এক দুশ্চরিত্রা নারীকে তার পিছনে লাগাতে হবে। নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগ তুলেই তাকে ওই যায়গা ছাড়া করতে হবে। সে মতে এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে প্রস্তুত করা হল। সেও খুব উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গেল। আজ রাতেই তারা কিছু করবে।
মেয়েটি যথা সময়ে জুরাইজের ইবাদত খানায় পৌছাল। রূপ-লাবন্য আর বাহারী সজ্জায় তার সারা গা ছেয়ে আছে। ছলনা ভরা চোখে কামনীয় ভঙ্গিতে জুরাইজকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করল। কিন্তু একি! এ যেন একটা আস্ত পাথর। কোন ভাব নেই। নেই কোন অনুভূতি। একবার তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করল না সে। যাকে কাছে পাওয়ার জন্য সারা শহর মাতোয়ারা তাকে এভাবে একান্তে পেয়েও এমন অবজ্ঞা!
নিজ সত্বার এহেন অপমান সইতে না পেরে মেয়েটি জিদে অধীর হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত কারো সামনে এতোটা ফিকে হয়নি সে। রাগ আর ক্ষোভে সারা দেহ জলে যাচ্ছে তার। ঠিক করল, যে করেই হোক জুরাইজের থেকে এই অপমানের বদলা গ্রহণ করতেই হবে। তাকে ব্যাবিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করতেই হবে। পাশেই ছিল এক রাখাল। মেয়েটি সেই মুহুর্তেই ওই রাখালের সাথে নিজের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করল। আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকল যে, এই বাচ্চা ভুমিষ্ট হলে জনসম্মখে তাকেই জুরাইজের সন্তান বলে প্রচার করবে। তবেই তার চিত্ত তৃপ্ত হবে।
তারপর কয়েক চাঁদ এলো গেল। জুরাইজের এসব কিছুই জানা নেই। তাকে নিয়ে কত গভীর ষড়যন্ত হতে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই কালো দিনটি এসে হাজির হল। জুরাইজ তার ইবাদত খানায় ইবাদতরত ছিল। হটাৎ বাইরে ব্যপক শোরগোল। এরই মধ্যে কজন ক্ষিপ্রগতিতে তার ঝুপড়িতে প্রবেশ করল। জুরাইজ কিছু বুঝে উঠার আগেই গালি গালাজ এবং চড় থাপ্পড়ের অনলবর্ষন শুরু হল।
সে দেখল, কিছু লোক তার জীর্ণশীর্ণ ইবাদত ঘরটির উপর হামলে পড়েছে। খুটি গুলো উপড়ে ফেলছে কেউ কেউ। কেউবা আগুন ধরিয়ে সব পুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় মত্ত। জুরাইজ নির্বাক তাকিয়ে আছে। এছাড়া আর কি করার আছে তার!
উপস্থিত লোকদের মধ্য হতে একজন সামনে বেড়ে আসল। একেবারে জুরাইজের সামনে বুক টান করে দাড়াল। বলল, কি বৈরাগী! আর কতদিন নিজের আসল চেহারা আড়াল করে রাখবে? এই বাচ্চা যে তোমার অবৈধ লীলার ফসল তা ইতিমধ্যেই জানাজানি হয়ে গেছে।
জুরাইজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কবে? কিভাবে কি? ইত্যাদী একঝাক অজানা প্রশ্ন তার দেহ মন জুড়ে আছড়ে পড়ল। এরই মধ্যে ভিড় ঠেলে সামনে হাজীর হল সেই কালনাগীনী। সেই রাতের প্রতিশোধ নিতেই এতো আয়োজন। চোখে মুখে তার বিজয়ের হাসি। জুরাইজের এমন চুন কালী মাখা চেহারা খুব স্বাদ নিয়ে উপভোগ করছে সে। ঠোটের কিনারায় একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, কি জুরাইজ মনে নেই? ওই যে সেই রাতে তুমি আমার সাথে যা করেছিলে। এতো সেই রাতেরই ফসল। তোমারই সন্তান।
জুরাইজের বুঝতে বাকি থাকলো না যে, সে কঠিন এক ষড়যন্ত্রের শিকার। সে তার চারপাশ দেখছে। আজকে তার পক্ষ সমর্থনকারী কেউ নেই। যেন আকাশ বাতাস সব আজকে ওর বিপক্ষে। কিন্তু একজন তো আছে। যার সাথে জুরাইজের রাত্র দিন কেটেছে। এই একাকী বিজন জঙ্গলে। তিনি তো আর তাকে একা ফেলে যেতে পারেন না। আজকে তিনিই জুরাইজের একমাত্র ভরসা। কেবল তিনিই পারেন তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
উপস্থিত সকলের চোখগুলি জুরাইজের উত্তরের অপেক্ষায় তার প্রতি নিবিষ্ট। নিরবতায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। সে ধীর পদে হেটে বাচ্চার পাশে গিয়ে দাড়াল। মায়াভরা চোখে একনজর শিশুটিকে দেখল আর ¯েœহভারা হাত বুলিয়ে দিল তার নিষ্পাপ শিয়রে। তারপর উঠে এসে সকলের মাঝে দাড়াল। অজু করল তারপর পুরাতন ছেড়া মুসাল্লাটি বিছিয়ে দুই রাকাত নামাজের তাহরিমা বাধল।
নামাজী ব্যক্তি তার প্রভূর সাথে কথা বলে। কথাটির বাস্তব চিত্র যেন জুরাইজের এই দুই রাকাত। স্থীরতা, নিমগ্নতা আর শান্তভাব। নেই কোন ব্যস্ততা বা অস্থিরতা। সালাম ফিরিয়ে প্রসান্ত চিত্তে আবার বাচ্চাটির কাছে আসল। চেহারায় সামান্য চিন্তার লেশ মাত্র নেই। যেন তার কিছুই হয়নি।
জুরাইজ বাচ্ছার পেটে মৃদু আঘাত করল। আর তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বল! তোমার বাবা কে? উপস্থিত সবাইতো হতবাক। আরে, বাচ্চার কাছে এই প্রশ্ন কেন? সেকি কথা বলতে পারে নাকি। এছাড়া এই ছোট বাচ্চা তার বাবার কথা জানবেই বা কিভাবে?
তাদের ভাবনার রেশ না কাটতেই হটাৎ শিশুটির ওষ্ঠাধর কেপে উঠল। সে কিছু বলতে চাচ্ছে। সবার চোখগুল বড় বড় হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। কান সজাগ করে তার মুখনিশ্রিত সব্দমালার প্রতি নিবিষ্ট হল সবাই। এমন সময় বাচ্চাটি বলে উঠল, আমার বাবা অমুক রাখাল।
নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। আমি যা শুনলাম সবাই কি তাই শুনেছে। আসলেই কি শিশুটি কথা বলেছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সবাই জুরাইজের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলিঙ্গন করে বুকে টেনে নিল। শ্রদ্ধাভরে তার কপাল চুমতে লাগল অনেকেই। বলল, আমাদের মাফ করে দাও। আমরা তোমার ইবাদত খানাটি ভেঙ্গে দিয়েছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কথা দিচ্ছি, আমরা স্বর্ন দিয়ে তোমার ইবাদত ঘর নতুন করে বানিয়ে দিব।
জুরাইজ বলল, স্বর্ন দিয়ে বানানোর প্রয়োজন নেই। তোমরা আমাকে আমার পূর্বের ঝুপড়ি ফিরিয়ে দাও। ডাল, পাতার ঘরই আমার সই। অগত্যা লোকেরা তাই করল। এভাবেই মহান আল্লাহ তাকে এই মহা বিপদ থেকে মুক্ত করলেন। (সহীহ বুখারীর ৩৪৩৬ নং হাদীস অবলম্বনে)
খুলনা গেজেট/ টি আই