খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আইপিএল ইতিহাসে সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার ঋষভ পন্ত

মাহে রামাযানের গুরুত্ব, ফযীলত ও করণীয় আমল

হাফেজ মাওলানা মুফতি জুবায়ের হাসান

বছরের অন্যান্য মাসের মধ্যে মাহে রামাযানের অবস্থান অনন্য। এ মাসের আছে এমন কিছু বৈশিষ্ট, যা অন্যান্য মাসের নেই। ঐসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যতই চিন্তা করা যায় ততই এ মাসের মহিমা ও গুরুত্ব প্রকাশিত হয়।

প্রথম বৈশিষ্ঠ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে এমাসের নাম উল্লেখ করে মাসটির ফযীলত ও গুরুত্ব ঘোষণা করেছেন।

মাহে রামাযানের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

অর্থাৎ, মাহে রামাযান, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন যা মানুষের জন্য হেদায়েত ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং (যা আসমানী) হেদায়েত ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী। -সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৮৫

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত বিভিন্ন ফযীলত। আল্লাহ তাআলা এই মাসকে নির্ধারিত করেছেন তাঁর মহিমান্বিত কালাম নাযিলের জন্য, যা জগতবাসীর জন্য হেদায়েত এবং হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। আর এ মোবারক মাসে একটি রজনীকে এমন মর্যাদা ও মহিমা দান করেছেন যে, তা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ দুই বৈশিষ্ট কুরআন মাজীদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়েছে। আর হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাআইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت ابواب جهنم وصفدت الشياطين

যখন মাহে রামাযানের আগমন হয় তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯

এই হাদীস শরীফও সংবাদ দান করে যে, এ মাসে উর্ধ্ব জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সকল নেয়ামতের স্থান জান্নাতের দরজাসমূহ আল্লাহর আদেশে খুলে দেওয়া হয়। আর চির অশান্তির স্থান জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। এ যেন পরওয়ারদেগারের আহবান -কে আছ, জান্নাতে যেতে চাও, আমি তাকে জান্নাতে দাখিল করব। কে আছ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাও, আমি তাকে মুক্তি দান করব। অতএব বান্দার কর্তব্য গুনাহ ও পাপাচার থেকে পবিত্র হয়ে চিরমুক্তির পরওয়ানা হাসিল করা। বিতাড়িত শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে অন্যায় অনাচারের এক বড় সূত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোটকথা গোটা মাসজুড়ে রহমত ও মাগফিরাতের বারিধারা বর্ষণ হয় এবং মুক্তির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করে।

এ মাসের আরও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সওম ও তারাবী এ মাসে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সূরা বাক্বারার যে আয়াতে মাহে রামাযানের ফযীলত ঘোষিত হয়েছে তার আগের দু’টি আয়াতই হচ্ছে সওমসংক্রান্ত ঐ প্রসিদ্ধ আয়াত, যা এ মাসে মিম্বরে মিম্বরে পঠিত হয়-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে রোযা, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার। (গুনাহ থেকে এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে এ মাসে উপস্থিত হয় সে যেন মাসভর রোযা রাখে। -সূরা বাক্বারা, আয়াতঃ ১৮৫

অসুস্থ ও মুসাফির ছাড়া প্রত্যেক বালিগ মুসলিমের উপর সারা মাস রোযা রাখা ফরয। এ শুধু মাহে রমাযানেরই বৈশিষ্ট্য। এ বিধান অন্য কোনো মাসে নেই।

সূরা বাকারার যে আয়াতগুলিতে রোযা ফরয হওয়ার বিধান এসেছে তাতে চিন্তা করলে দেখা যায়, একদিকে আল্লাহ রোযাকে ফরয করেছেন, অন্যদিকে অপারগতার ক্ষেত্রে অবকাশ দিয়ে এ বিধানকে সহজ করেছেন। উপরন্তু দয়াময় মালিক এ বিষয়ে এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, বান্দার জন্য তা আর কঠিন থাকেনি, মধুময় হয়ে উঠেছে।

মাহে রামাযানের দ্বিতীয় বিশেষ ইবাদত হল তারাবীহ। বলাবাহুল্য, এ-ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতেই প্রদত্ত। তবে দয়াময় মালিক তা দান করেছেন রসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহের মাধ্যমে এবং রোযার মতো একে ফরয করেননি। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, এক রামাযানে দুই বা তিন রাত সাহাবীগণ তারাবীর নামাযে নবী করীম ﷺ এর পিছনে ইকতেদা করেছেন। অর্থাৎ তারাবীর নামায জামাতে পড়া হয়েছে। কিন্তু পরের রাতগুলোতে নবী ﷺ হুজরা থেকে বের হননি। এর কারণ দর্শিয়ে তিনি বলেছেন, তোমাদের অপেক্ষা সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম, কিন্তু আমার আশঙ্কা হয়েছে (এভাবে জামাতে তারাবীহ চলতে থাকলে) তা ফরয করে দেওয়া হতে পারে।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী করীম ﷺ তারাবীহ নামাযকে আমাদের জন্য অপরিহার্য করেননি তবে তিনি উৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রামাযানের রাতে (নামাযে) দাঁড়ায় তার পূর্বকৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৯
ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে’ কথাটির মূল অর্থ, বিশ্বাসের সাথে, পুণ্যের আশায়। তো এ দু’টি ইবাদত অর্থাৎ রোযা ও তারাবীহ হচ্ছে মাহে রামাযানের বিশেষ ইবাদত। রামাযান ছাড়া অন্য কোনো মাসের রোযাকে আল্লাহ তাআলা ফরয করেননি। তেমনি অন্য কোনো মাসে তারাবী পড়ারও সুযোগ নেই। আর রামাযান যেহেতু আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য হাসিলের জন্য, তারাবীহ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য সেতু-বন্ধনের ন্যায়। কেননা ২০ (বিশ) রাকাত তারাবীহে একজন বান্দার আল্লাহ পাকের দরবারে ৪০ (চল্লিশ)টি সেজদা করার সুযোগ লাভ হয়। হাদীসে এসেছে, বান্দা সেজদার মাধ্যমে যতটা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, অন্য কোন আমলের দ্বারা ততটা নিকটবর্তী হতে পারে না। সুতরাং যে সকল ব্যক্তিগণ বলে, তারাবীহ ২০ (বিশ) রাকাত নয়; মূলতঃ তাঁরা তারবীহ এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হয়নি।

তৃতীয় বিষয়টি সাধারণ। তা হচ্ছে গোনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। অন্য মাসেও তা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মাহে রামাযানে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। তেমনি সাধারণ ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল সব সময়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাহে রামাযানে এর ফযীলত অনেক বেড়ে যায়। অতএব সাধারণ ইবাদত-বন্দেগীর বিষয়ে আরো বেশি যত্নবান হওয়া এবং গুনাহ ও পাপাচার থেকে আরো গুরুত্বের সাথে বেঁচে থাকা এ মাসের করণীয়ের অন্তর্ভুক্ত।
মাহে রমযানের মর্যাদা কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যাবেঃ

এ মাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রথম করণীয়, আল্লাহ তাআলা এ মাসে ইবাদতের যে বিধান দিয়েছেন এবং নবী করীম ﷺ যে ইবাদত সুন্নাহ সাব্যস্ত করেছেন, অর্থাৎ রোযা ও তারাবী তা যথাযথভাবে আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।

২. শরীয়তসম্মত ওযরবশত পানাহার করতে হলে প্রকাশ্যে না করা। চিন্তা করার বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রে শরীয়তে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইমীন’(রোযাদারগণের সাদৃশ্য গ্রহণ)-এর বিধান আছে। এর তাৎপর্য রমাযানের মর্যাদা রক্ষা করা। যেমন মুসাফিরের জন্য রোযা না-রাখার অবকাশ থাকলেও কোনো মুসাফির যদি দিনের বেলা মুকীম হয়ে যায় তাহলে তার কর্তব্য, অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। এতে কি রোযা হবে? রোযা হবে না, কিন্তু রোযার মর্যাদা রক্ষা হবে। তেমনি হায়েয বা নিফাসের অবস্থায় মহিলাগণ রোযা রাখতে পারেন না, কিন্তু কোনো মহিলা যদি দিনের বেলায় হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হন তাহলে তার কর্তব্য, বাকী দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। (যদিও হায়েয বা নিফাসগ্রস্ত অবস্থায় তার পানাহারের অনুমতি আছে। তবে সেক্ষেত্রেও নিয়ম হল গোপনে পানাহার করা।) একে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইম’ বলে। অর্থাৎ রোযাদারের সাদৃশ্য অবলম্বন। এ বিধান তো রামাযানের মর্যাদার জন্যই দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে আনুগত্য ও সমর্পণ, আর সবচেয়ে অপ্রিয় অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ। তাই অন্তরের অবাধ্যতার মতো বাহ্যিক অবাধ্যতা থেকেও আত্মরক্ষা প্রয়োজন। এমনকি অবাধ্যতার সামান্য সাদৃশ্য থেকে বেঁচে থাকাও মুমিনের কর্তব্য।

ইসলামে সাদৃশ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রসিদ্ধ হাদীস-
من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থাৎ যার সাদৃশ্য যে সম্প্রদায়ের সঙ্গে বস্তুত সে তাদেরই একজন।

৩. যেসব গুনাহের কাজ প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে করা হয় সেগুলো থেকে নিজেও বিরত থাকা, অন্যকেও বিরত রাখা। যেমন গান-বাজনা, প্রাণীর ছবি ও প্রাণীমূর্তির প্রদর্শনী, বেপর্দা চলাফেরা ইত্যাদি।

৪. দিনের বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানাহার বন্ধ রাখা।

৫. পুরুষেরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতে আদায় করা। এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি, আড্ডা, গল্প-গুজব ও অন্যান্য কর্মব্যস্ততা থেকে বিরত থাকা।

এরকম আরো বিষয় আছে। সর্বশেষ যে বিষয়টি বলে শেষ করছি তা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে এ মাসকে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জন্য কষ্টের মাসে পরিণত না করা। অন্তত মুসলিম ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের তো কিছুটা ‘ত্যাগ’স্বীকার করে হলেও এদিকে নজর দেয়া অতি জরুরি। আল্লাহ উত্তম তাওফিক দাতা।

( লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কুয়েট)

 

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!