দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে কমবেশি ঘুষ তোলা হয় ১২ কোটি টাকা। বিভিন্ন হারে যার ভাগ যায় প্রধান কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের পকেটেও। এ রকম ঘুষ কারবারের তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তারিত প্রতিবেদনে।
যেখানে তৌফিকুল ইসলাম নামে এক পরিচালকই ৩ বছরে মাসোয়ারা তুলেছেন প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। (বর্তমানে খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক পদে কর্মরত)। এ ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশের পর মঙ্গলবার দেশব্যাপী সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে অবশ্য তিনি সাংবাদিকদের কোন মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
জানা যায়, সাক্ষ্য প্রমাণসহ গোয়েন্দা সংস্থার চাঞ্চল্যকর রিপোর্টটি এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা বিলম্ব হলেও সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দুদকের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দুদকে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫শ’টি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালদের মাধ্যমে। দালালদের জমা করা আবেদন প্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন ১ হাজার টাকার নির্ধারিত রেটে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বিশাল অঙ্কের এই ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে ১ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে।এরপর প্রধান কার্যালয়ে আসা বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকা গ্রহণ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন ৪/৫ জন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তারা হলেন, উপপরিচালক বিপুল কুমার গোস্বামী, তৎকালীন উপপরিচালক (অর্থ) তৌফিকুল ইসলাম খান, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আজিজুল ইসলাম, সিস্টেম এনালিস্ট নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাসুদ রানা।
গত অক্টোবরে পাসপোর্ট অধিদফতরের দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করে। ৭/৮ জন কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা নিজেরাই তাদের ঘুষ কেলেঙ্কারির ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ২৫ জন পাসপোর্ট কর্মকর্তার নামের তালিকা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে পাঠানো হয়। এতে দেখা যায়, তৌফিকুল ইসলাম নামের এক পরিচালক একাই ২৯টি অফিস থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা তুলেছেন। যেসব অফিস থেকে তিনি মাসোয়ারা তুলেছেন সেগুলো হল- আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস, যাত্রাবাড়ী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মনসুরাবাদ, চান্দগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, যশোর, মৌলভীবাজার, মাদারীপুর, বরিশাল, বগুড়া, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর, চাঁদপুর , ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, রাজশাহী এবং মুন্সীগঞ্জ।
জানা যায়, উপ-পরিচালক পদ থেকে পদন্নতি পাওয়ার প্রায় ৩ মাস পর তৌফিকুল ইসলাম খান খুলনায় ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সাথে সহনীয় ব্যবহার না করার মত অভিযোগ আছে। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর পাসপোর্ট অফিসে অভিযান করে দুদক। এসময় পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের অভিযোগ করেন দুদকের অভিযান পরিচালনা দলের সদস্যরা।
এসব বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান মঙ্গলবার প্রতিবেদককে বলেন, ‘যে নিউজটি প্রকাশিত হয়েছে তার বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। যদি কারোও কোন সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে অফিসে এসে কথা বলতে হবে।
খুলনা গেজেট/নাফি