খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

মার্কিন দূতাবাস দর্শন ও আমার অর্জন

ফরহাদ হুসাইন

দূতাবাসে গণসংযোগের কাজ করি, ফলে বিভিন্ন দূতাবাসে প্রায় নিয়মিত যাওয়া হয়, এমনকি রাজদরবারে যাওয়ার ও সুযোগ মেলে, কিন্তু মার্কিন দূতাবাসে যাব বলে আজ অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছি। আরব আমিরাতে মোট ১২৫ দেশের দূতাবাস আছে, কিন্তু কূটনৈতিক পাড়ায় গেলে চোখ পাখির মত স্থির থাকবে মার্কিন দূতাবাসে। ভাবনটির আভিজাত্য, অবস্থান, নকশা এবং দূতাবাসটি ঘিরে বিশেষ পুলিশি তৎপরতা দেখলে মনে হবে নির্ঘাত কোন ঘাতকের অগ্রিম খবরে ঘাবড়ে আছে পুলিশ। দূতাবাসটির নিজস্ব নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, সংয়ক্রিয় সৌরশক্তি ব্যবস্থা, সর্বপরি তার স্থাপত্য ভাস্কর্য সৌর্ন্দয যেকোন দূতাবাস থেকে আলাদা নজর কাড়ে।

সকালে খোশমেজাজে আরবি অনুবাদক সহকর্মীকে জানালাম“ আমি ত আজ আমেরিকান দূতাবাসে যাচ্ছি, স্বভাব সুলভ স্বরে শান্ত ভঙ্গিতে আরবী বন্ধুটি বললো, ‘তুমি সহজে আমিরাতের পাররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢুকতে পারো আমি জানি, কিন্তু মার্কিন দূতাবাসে কাজ করে আসা তার চেয়ে শত কঠিন মনে রেখো।’ যাই হোক কঠিনেরে ভালবেসে ঔন্দ্রজালিক উপদেশ মেনে নিয়ে দূতাবাসের দূতাবাসের গেটে হাজির হলাম, গাড়ীর ডিপ্লোমেটিক লাল প্লেট দেখে নিরাপত্তাকর্মীকে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে কিছুটা আশান্বিত হলাম। কিন্তু আসলে সে এগিয়ে এসেছে. ব্রাহ্মণ ও শুদ্রের বিভেদ স্বরণ করিয়ে দিতে, মানে গাড়ী ডিপ্লোমেটিক প্রোটেকলের হলে ও মার্কিন দূতাবাসের পাকিং প্রবেশ করতে পারবেন না বাহিরেই পার্ক করতে হবে।‘

ডিপ্লোমেটিক প্রোটেকলের কোন গাড়ী বাংলাদেশে দূতাবাসে এলে মান্যবর রাষ্ট্রদূত স্যারের গাড়ীর পাশে পার্কিং করার জায়গা রাখা আছে। ড্রাইভার ভাইকে বল্লাম এই অপমানের বিষ পান করার দরকার নেই, আপনি বরং অফিসে চলে যান, কাজ শেষে হলে বলব, তখন এসে নিয়ে যাবেন। দূতাবাসের প্রবেশ পথে হাটার রাস্তা পার হয়ে নিরাপত্তারক্ষীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আগমন উদ্দেশ্য জানালাম, সে আমাকে কাঠের বেঞ্চে বসতে বল্লেন, আমি ইতস্তত করছি, এই গরমে বাইরে বসতে হবে ভেবে, পাশে তাকিয়ে দেখেলাম দুজন কূটনৈতিক আমার মত লাইনে অপেক্ষমান, মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। যাক বাবা, সিনিয়র কুটনৈতিকরা লাইন ধরেছে আমি ত কুটনৈতিক প্রতিনিধি মাত্র। মনের আয়নায় কল্পনা করলাম, এমন দু’জন লাল পাসপোর্টধারী ডিপ্লোম্যাট আমাদের দূতাবাসে গেলে এতক্ষণ রাষ্ট্রদূতের রুমে কফিকাপে চুমুক দিতেন আর আমাদের চঞ্চলতা বাড়তো পাসপোর্ট-এ ভিসা দিতে।

যা হোক, অবশেষে প্রথম দরজায় ডাক এলো, গলায় ঝুলানো আইডি কার্ড দেখে ইয়েস টিকিট পেলাম। গার্ড মোটা একটা ধাতব দরজার কাছে নিয়ে দাড় করালো, ভাবলাম দরজা পার হতে পারলেই বুঝি সিদরাতুন মুনতাহা(লক্ষস্থল)। কিন্তু কোথায় কি? দুজন মহিলা গার্ড শরীর তন্ন ত্ন্ন করে পরীক্ষা চালালো। পকেটের ওয়ালেট, মোবাইল, খুচর পয়সা, হাতের ফাইল, গায়ের কোট সবই তারা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা করে বিনয়ের ভঙ্গিতে বল্লো ‘আমরা কি আপনার মানিব্যাগ খুলে দেখতে পারি? অগত্যা মধুসূদন, ভাবখানা এমন যে, কাপড় খুলতে বলোনি তাতেই খুশি। অতঃপর একটা স্টিকার ধরিয়ে দিয়ে জানালো, মোবাইল তাদের জিম্মায় থাকবে, বের হবার সময় তা দেখিয়ে ফেরত নিতে পারব। আরো দুটি ধাতব দরজা পার করে একটি রুমে নিয়ে গায়ের কোট, কোমরের বেল্ট, জুতা, আইডি কার্ড পরার অনুমতি দিল। আরেকটি দরজা পার করে হাটার রাস্তা নির্দেশ করলো, আমি অনুশরণ করে কনস্যুলার সেকশনে পৌছলাম, সেখানে ও দুটো বড় ধাতব দরজা, সজোরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকতে হলো, হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো, বয়স্ক লোকের এই দরজা ঠেলে ঢোকার সাধ্য কি? অনুসন্ধিচ্ছু চোখে খুজে পেলাম, বিশেষ বোতাম যেটা টিপে বয়স্ক ও অসুস্থ লোক ঢুকতে পারে। হেটে এসে টোকেন নিয়ে ঠায় বসে রইলাম, সেবা প্রত্যাশী দুজন কূটনৈতিক, তিন জন লোকাল আরবী, এক জন জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং আমি। এই সংরক্ষিত ঘরে সাত জনকে ঘিরে প্রায় ডজন খানেক সিকিউরিটি গার্ড ঠাই দাড়িয়ে রইল।

দূতাবাসের স্তরে স্তরে বহুস্তরের নিরাপত্তা। ততক্ষণে সময়ের সদ্বব্যবহার করে আসুন বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার সেবাচিত্র দেখে আসি। দৈনিক শ’দুয়েক রেমিট্যান্স যোদ্ধা স্বদেশীর সাথে গোটা বিশেক বিদেশী নাগরিক দূতাবাসের দাওয়ায় ভিসা নিতে আসে। প্রিয়দর্শিনী অভ্যর্থনাকারীনি তাদের সম্ভাষণ জানিয়ে আরামদায়ক আসনে নিয়ে বসান। প্রয়োজনানুসারে শুরু হয় সেবাদানের ব্যস্ততা, কিন্তু তাতে ও শান্তি নেই, শুরু করে জেরা নয়ত জাহির করার জারিজুরি। ভাবখানা এমন যে, দূতাবাস ত বাংলাদেশের (তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অর্থে) তাহলে বিলক্ষণ বিলম্ব কেন? আরে ভাই, ভিসা ইস্যুর আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ত প্রায় সমান হোক না সে দেশ বলশীল বা বলহীন। ভিসা প্রার্থী যদি আরবী লোক হয় তবে ত কথাই নেই। সম্পদ ও সম্মান যতই থাকুক সবর জিনিসটির সন্ধান আল্লাহ তাদের দেননি, স্বশব্দ শব্দ দূষণ শুরু হবে لماذا التأخر , اين ضابطك, اريد ان اتحدث (কেন বিলম্ব হবে? কোথায় তোমার অফিসার, আমি কথা বলতে চাই) ইত্যাদি শব্দে তটস্থ করে তুলবে সকলকে। অথচ এই ধৈর্য্যহীন আরবী লোকদের মার্কিন দূতাবাসে অতি ধৈযশীল ও বিনয়ীভাব দেখে এলাম, পার্থক্য কেবল ক্ষমতার। তাদের ক্ষমতা অপরিসীম; ধৃষ্টতা দেখালে অধরা হতে পারে ভিসা, তাই সেখানে তারা বেজায় বিনয়াবনত হয়ে বসে থাকে। এটা মানুষের স্বভাবজাত, বিদেশী কেন বলি? স্বদেশীদের আচারণ ও ভিন্ন নয় ।

প্রতিদিন প্রায় গড়ে দুই শতাধিক বাংলাদেশী সেবাপ্রার্থী আসেন দূতাবাসে। তাদের আচারণ, চাহিদা ও বহুধাবিভক্ত। বাংলাদেশীরা যখন বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন বা কোন প্রয়োজনে ভিনদেশী সরকারি বা কর্পোরেট অফিসে যান তখন তার শান্ত ও সুশৃঙ্খল আচারণ করে সুনাম কুড়ায়, কিন্ত দেশের প্রতিষ্ঠান বা দূতাবাসে আসলে তারা নম্বর নিয়ে লাইলে দাঁড়াতে একেবারেই নারাজ, নিজের বাড়ী বলেই বাড়তি আবদার হয়ত। আমি দেখেছি ঢাকা বা চট্র্রগ্রাম থেকে যখন বাংলাদেশী যাত্রী এমিরেটস বা ইত্তেহাদ বিমানের চড়েন তখন শুনশান, শান্ত সুন্দর সব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই যাত্রী যখন বাংলাদেশ বিমানে চড়েন তখন আচারণ একেবারেই বিপরিত, বিশৃঙ্খল; কি বৈচিত্র আমাদের আচারণে । একেবারেই উল্লেখিত আরবদের মত।

যাই হোক অবশেষে অপেক্ষার প্রহর পোহালো। ভদ্র মহিলা আমাদের দিকে একবার ও তাকালেন না, কাগজ-পত্রের ফরেনসিক পরীক্ষা চালালেন, আমার পরিচয়পত্র তিনি নিখুদ ভাবে দেখলেন সদয় হলেন, অতঃপর আমি একটার পর একটা ধাতব দরজা পেরিয়ে ফিরে এলাম, ক্ষমতার উপর নাকে খত দিয়ে, দূতাবাসের বাইরে এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহোশয়ের কবিতাংশ “দেখিস, একদিন আমরাও…” মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ফিরে এলাম।

(ফেসবুক ওয়াল থেকে)

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!