“ধর্ষণ মামলার আসামী সুমন জামিনে ছাড়া পেয়ে মামলাটি তুলে নিতে আমাকে ও আমার স্বামীকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। দ্রুত মামলা তুলে না নিলে ধর্ষণের সময়ে করা ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেবার হুমকি দিচ্ছে। ধর্ষণের পর বাড়িওয়ালা তার বাসা থেকে আমাদের বের করে দিয়েছে। উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম স্বামীর ওষুধের ফার্মেসিটিও অচলাবস্থা। তিন/চার মাসের ঘর ভাড়া বাকী, বাইরেও বের হতে পারি না। ঘরের মধ্যে না খেয়ে মরার মতো অবস্থা।” অগোছালোভাবে কথাগুলো খুলনার শিববাড়ী মোড়ে ধর্ষণ বিরোধী কর্মসূচীতে দাড়িয়ে বললেন নগরীর টুটপাড়া এলাকার একজন নির্যাতিত নারী। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি। নিজের ও স্বামী-সন্তানের জীবন রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এই সংখ্যালঘু নারী।
তিনি জানিয়েছেন, গত ২ মে দুপুরে টুটপাড়া ফায়ার স্টেশন এলাকার ভাড়া বাসায় ওই নারীকে ধর্ষণ করে দিলখোলা রোডের নাহিদ। ধর্ষণের এ দৃশ্য ভিডিও রেকর্ড করে তার সহযোগী জুয়েল। আর নির্যাতিত নারী সম্পর্কে আগে-পরে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে ধর্ষকদের সহায়তা করেছে মাছ ব্যবসায়ী সুমন। সপ্তাহখানেক হলো সুমন জামিনে ছাড়া পেয়ে নগরীর গগন বাবু রোডের চিহিৃত মাদক বিক্রেতা জনিকে দিয়ে ও সুমন নিজেই সরাসরি নির্যাতিতার স্বামীকে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছে। মামলাটি দ্রুত প্রত্যাহার করে না নিলে জীবনে শেষ করে দেবার হুমকি দিচ্ছে ধর্ষণ মামলার আসামী সুমন। এখন পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান ও স্বামীর জীবন নিয়ে চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন ওই নির্যাতিত নারী।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা থানার এস আই আবু সাঈদ বললেন, “হাইকোর্ট থেকে সুমন শিকদার নামে আসামী ১ অক্টোবর জামিন পেয়েছে। আজকেই শুনলাম ধর্ষিত নারীকে সুমন মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছে। আমি ওনার স্বামীকে বলেছি, থানায় এসে একটা সাধারণ ডায়েরি করতে। জিডি করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, ধর্ষণ মামলার আসামীরা হল- নগরীর টুটপাড়া মেইন রোডের ১৪/১ মোঃ আইয়ুব আলী মিয়ার ছেলে মোঃ নাহিদুজ্জামান (৪৪), ৩নং টুটপাড়া দিলখোলা রোডের মৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে আলী ইমরাজ জুয়েল (৪৪) এবং ৪৩/১ টুটপাড়া দিলখোলা রোডের সৈয়দ আলী শিকদারের ছেলে সুমন শিকদার (৩৮)। মূল ধর্ষক নাহিদুজ্জামান ও ভিডিও ধারণকারী ইমরাজ জুয়েল বর্তমানে কারাগারে আছে।
শুধু এই সংখ্যালঘু নির্যাতিতা নারী-ই নন। গেল তিন মাসে খুলনা অঞ্চলে ধর্ষিত অন্তত অর্ধশত নারী ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ধর্ষক ও ধর্ষকের পরিবার আত্মীয়-স্বজন প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর। ইতোমধ্যে সামাজিক কিছুটা বিচ্ছিন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকায় ধর্ষক কর্তৃক হুমকির প্রতিবাদও করতে পারছে না ভুক্তভোগীরা।
খুমেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সূত্রমতে, গেল তিন মাসে ৫১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে ভর্তি হয়। এরমধ্যে নয়জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। অন্যদের ১৮বছরের উর্দ্ধে ও ৬৫ বছরের মধ্যে। গত ২৪ সেপ্টেম্ববর ধর্ষণের শিকার হন, নগরীর খালিশপুর এলাকায় ৬৫ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা। এছাড়া বেশির ভাগ ঘটনাই খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা উপজেলার।
সূত্রে জানা গেছে, জেলার কয়রা উপজেলার বালিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা সাড়ে ৪ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে গত ১৮ আগস্ট ওসিসিতে ভর্তি হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তেরখাদা উপজেলায় পুলিশ সদস্য কর্তৃক চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী (৯) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় পুলিশ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের মোকামপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামকে (২২) গ্রেপ্তার করে। তিনি নাটোর পুলিশ লাইনসে কর্মরত। ধর্ষক রেজাউলের পিতাও পুলিশে চাকরি করেন, তিনিই এখন ভুক্তভোগী পরিবারকে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।গত ১৬ সেপ্টেম্বর যশোরের কেশবপুরের পল্লীতে শারিরিক প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে (২০) ধর্ষণের অভিযোগে আব্দুল মোমিন (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। ১৫ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকূপায় বগুড়া গ্রামে জোরপূর্বক ধর্ষণে ১৩ বছরের এক শিশু অন্তঃসত্বা হয়ে পড়েছে। ওসিসিতে ভর্তির করে ওইসব নারী ও শিশুকে ডাক্তারী পরীক্ষার পর তাদের চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। পরে তারা নানামুখী হুমকিতে পড়লেও এগিয়ে আসছে না কেউ।
নগরীর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা এলাকায় ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পিতা বললেন, “কোন ধর্ষণের সঠিক বিচার পাওয়া যায় না। যে কারণে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে আমাদের সন্তান, আমাদের মা, আমাদের বোন। একটি সঠিক বিচার হলে ধর্ষণের পরিমাণ কমে যেত বলে মনে করেন তিনি।
৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ডাঃ বাহারুল আলম বলেন, ‘ধর্ষকরা নিজেদের খুব শক্তিশালী মনে করে। তারা মনে করে- তারা আইনের উর্দ্ধে। এই কারনেই তারা অন্যায় করে, করছে। অতএব ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ হলে অপরাধীদের অপরাধ প্রবনতা কমে যাবে।’
নারী নেত্রী এ্যাড. শামীমা সুলতানা শিলু বলেন, “সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আগে যে নৈতিক শিক্ষা দেয়া হতো, সেটি বর্তমানে নেই। যে যার মতো থাকেন, কারোর সাথে কারোর কোন সম্পর্ক নেই। আমি আমার পাশের ফ্ল্যাটে কে আছে, সেটি জানি না। আমাদের সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারলে ধর্ষকরা নির্যাতিতদের হুমকি দেবার সাহস পেতো না।”
খুলনা গেজেট/এআইএন