বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আনন্দঘন ঈদে মানুষের মনে সুখ নেই, আনন্দ নেই। মানুষের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে এই লুটেরা সরকার। মানুষের ঘরে খাবার নেই। উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এখন অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা, তারাও কোরবানি করার সামর্থ হারিয়ে ফেলেছে। কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা কম, যারা আছেন বেশিরভাগ সরকারি দলের লুটেরা, অবৈধ অর্থের মালিকরা।
আজ রোববার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেন, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শেয়ার বাজার থেকে আরম্ভ করে পাড়া মহল্লার কাঁচা বাজার পর্যন্ত প্রতিটি সেক্টরেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে অসহায় সাধারণ জনগণ। লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজারে গরুর গোস্তের কেজি আট শ’ টাকা, ঈদে খাবার প্রস্তুতে ব্যবহারকৃত মসলা যেমন- এলাচের কেজি চার হাজার টাকা, লবঙ্গের কেজি প্রায় দুই হাজার, দারচিনির কেজি প্রায় ছয় শ’ টাকা, তেজপাতার কেজি তিন শ’ টাকা, জনগণ যেন এক খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। শশার কেজি ১২০ টাকা, কাচা মরিচ ২৬০ টাকা, করলা কেজি প্রতি ৭০ টাকা অর্থাৎ শুধু মাছ গোস্তই নয় শাক-সবজিতেও হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রভাহিত হচ্ছে। দেশের সবকটি ব্যাংক এখন প্রায় দেউলিয়া। শুধু ডলার সঙ্কটই নয়, ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এমনকি ঈদের সময়েও ব্যাংকে গিয়ে গ্রাহকরা চাহিদামতো নগদ পাঁচ হাজার টাকাও তুলতে পারছেন না। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যাবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা বিদেশ যেতে পারছে না।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। ব্যাংকের ‘লকার’ থেকে গায়েব করে দেয়া হচ্ছে গ্রাহকদের শত শত ভরি স্বর্ণ। এমনকি গ্রাহকদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকার ভল্টও এখন নিরাপদ নয়। রফতানি বাণিজ্যে চরম হতাশা। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশ সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। দেশী-বিদেশী ঋণের ভারে জর্জরিত। এই হলো দেশের আর্থিক পরিস্থিতি। স্বাধীনতা, সাফল্য সমৃদ্ধি আর গণতন্ত্রের মহানায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশকে অর্থনৈকিভাবে স্বাবলম্বী করে বিদেশে চাল চিনি রফতানি শুরু করেছিলেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে বাংলাদেশ এশিয়ার ইমার্জিং টাইগারে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনা আর তার মাফিয়া চক্রের দুর্নীতি লুটপাটের কারণে সেই বাংলাদেশ বর্তমানে আবার তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাফিয়া সরকার এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরছে।
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ‘৯০ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ স্লোগানটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মনোযোগ কেড়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই স্লোগানটি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে পাশাপাশি ‘দেশ আজ নির্লজ্জ তাবেদার এক সেবাদাসের খপ্পরে’। এ কথাটা কেন বললাম? কারণ অবৈধ ক্ষমতালিপ্সার কারণে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার হারিয়ে জনগণ আজ নিজ দেশেই যেন পরাধীন এবং বন্দী। অরক্ষিত দেশের সীমান্ত। সেন্টমার্টিন প্রায় অবরুদ্ধ। বাংলাদেশের নাগরিকগণ সেখানে যেতে নিরাপদ বোধ করছে না। সেন্টমার্টিনকে ঘিরে গত কয়েকদিন মিয়ানমার যা করছে, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চূড়ান্ত হুমকি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে দীর্ঘদিন থেকেই চরম অস্থিরতা চলছে। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ভারী অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। যুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের জান্তা সেনারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও প্রায়ই ঢুকে পড়ছে। পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। অথচ, গত ৭/৮ বছরেও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে দেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজনকেও মিয়ানমার ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি? বাংলাদেশ কি কোনো দেশের স্বার্থ রক্ষা করছে? তাহলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে? মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশ কি নীতি অবলম্বন করছে, অবশ্যই জনগণের সেটি জানার অধিকার রয়েছে।
রিজভী বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকগণ যেন আজ কোনো সীমান্তেই নিরাপদ নয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশসহ মোট সাতটি দেশের সীমান্ত রয়েছে। অন্য কোনো দেশের সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা করার সাহস না করলেও বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায়ই বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশী নাগরিক। গত ৯ জুন কুমিল্লা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এভাবে ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আর তাবেদারী মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদ করার সাহস এবং স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে আওয়ামী সরকার। আজ বাংলাদেশের সীমান্ত অনিরাপদ। বিপন্ন স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব। অথচ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার তাবেদার সরকার-নির্বিকার।
তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল শনিবার এক ভার্চূয়াল বক্তৃতায় প্রশ্ন রেখেছেন সার্বভৌমত্ববিরোধী তৎপরতা চললেও সীমান্ত জুড়ে এখনো কেন সেনাবাহিনী মোতায়ন করা হচ্ছে না? তিনি অবিলম্বে সীমান্তজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার আহবান জানিয়েছেন।
রিজভী বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম খুন অপহরণের শিকার হয়েছে। মিথ্যা কিংবা গায়েবি মামলায় সারাদেশে লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেকেই মাসের পর মাস ঘর ছাড়া। তারপরও বিএনপি রাজপথ ছাড়েনি। গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথ ছাড়েনি।
তিনি বলেন, দেশকে মাফিয়াতন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব বিএনপি কিংবা একক কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। মাফিয়া চক্রের কবল থেকে দেশকে পুনরুদ্ধার করতে হলে ভয়কে জয় করে প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যিনি যা জানেন সাহসের সাথে প্রকাশ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময়, শেখ হাসিনা কোটা প্রত্যাহারের আশ্বাস দিয়েছিল। এখন আবারো সেই কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছে। এটি স্পষ্টই শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা। এই সরকার প্রতারক বলেই বার বার জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। ‘কোটা’ কখনো মেধার বিকল্প হতে পারে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, চাকুরি কোটার ব্যাপারে ছাত্র তরুণদের দাবি অবশ্যই ন্যায্য এবং যৌক্তিক। জনগণের রায়ে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে অবশ্যই ছাত্র-তরুণদের যেকোনো যৌক্তিক এবং ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন করবে। একইসাথে প্রতিবন্ধীদের বিষয়টিও রাষ্ট্র অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি, সিদ্ধান্তে অবিচল থাকি, অচিরেই একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক সরকার গঠিত হবে। ইনশা আল্লাহ।
রিজভী বলেন, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ন্যায়নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবো সকল ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। দেশের এমন চতুর্মুখি সঙ্কটকালে আর বসে থাকার সময় নেই। মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ওদের হাতে গোলামীর জিঞ্জির আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা। স্বাধীনতার পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতে চাইলে, তাবেদার অপশক্তির কাছ থেকে দেশ উদ্ধার করার বিকল্প নেই। অন্যথায় সেদিন আর বেশি দেরি নয়, যেদিন আমাদেরকে হয়তো মাতৃভূমিতেই ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যবরণ করতে হবে। লেন্দুপ সরকার প্রধানের তাবেদারির কারণে আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। লাখো প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। আর এবারের মুক্তিযুদ্ধ দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। অতএব, গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির প্রতি উদাত্ত আহবান, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনের চলমান লড়াইয়ে শরিক থাকুন। মা-মাটি দেশ আজ সঙ্কটে। ডামি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে না পারলে দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা থাকবে না। আমরা কি বুয়েটের আবরার কিংবা ফরিদপুরের মধুখালীর আশরাফুল-আসাদুলের মতো অসহায়-নির্মম মৃত্যু চাই? চাই না। তাহলে আসুন আমরা মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনে ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো চরম ত্যাগ শিকারের জন্য আবারো প্রস্তুত হই। স্লোগান তুলি, আমার অধিকার আমার দেশ-টেইক ব্যাক বাংলাদেশ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা: রফিকুল ইসলাম, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য তারিকুল আলম তেনজিং প্রমুখ।
খুলনা গেজেট/এনএম