মানুষের জীবনে ঘুম আল্লাহর দেওয়া অনেক বড় একটি নেয়ামত। সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয় ঘুমে। সাস্থ্য তার কর্মক্লান্ত ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের রিপেয়ারিং করার মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নেয় এই ঘুমকে। কিন্তু রহস্যে ভরা এই ঘুম নিয়ে মানুষের রয়েছে নানা কৌতুহল। ঘুমের সময় আমরা জীবিত থাকি নাকি মৃত ? তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
মৃত্যু আর ঘুমের মধ্যে পার্থক্য হলো, ঘুমালে শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান থাকে আর মৃতু ব্যক্তির থাকেনা। বলা যায় গাড়ি চলেনা তবে ইঞ্জিন চালু। আর বাকি সব দিক দিয়ে মৃত মানুষের মত। কেন এমন হয়?
বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসছে, তাবে আমরা আলোচনা করবো কুরআন ও হদিসে এ ব্যাপারে কি নির্দেশনা আছে।
কুরআন বলছে ঘুমের সময় মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ সামান্য পার্থক্য ছাড়া মানুষ প্রায় মৃতের মত হয়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে-
وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُمْ بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَى أَجَلٌ مُسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
ঐ সত্তা যিনি রাতের বেলায় তোমাদের মৃত্যু দেন, আর দিনে তোমরা যা কর তা তিনি জানেন। আর দিনের বেলায় (ঘুম থেকে জেগে উঠার সময়) তোমাদের রূহ পাঠিয়ে দেন, যাতে তার মেয়াদ (হায়াত) পূর্ণ করা যায়। অতপর (স্থায়ী মৃত্যুর পর) তার কাছেই ফিরে যেতে হবে এবং তিনি তোমাদের জানাবেন তোমরা যা করতে (সুরা আনআম -৬০) ।
মুফাস্সিরদের সরদার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) “রাতের বেলায় তোমাদের মৃত্যু দেন” এর ব্যখ্যায় বলেন-
يقبض أرواحكم فِي الْمَنَام
ঘুমের মধ্যে রূহ কবজ করেন। আর দিনের বেলায় ফেরত পাঠান মানে-
يرد إِلَيْكُم أرواحكم لكَي يتم أجلهَا وَرِزْقهَا
দিনে তোমাদের রূহ ফেরত পাঠান তোমাদের হায়াত ও রিযিক শেষ হওয়া পর্যন্ত (তানবিরুল মিকবাস ফি তাফসিরে ইবনে আব্বাস ১১১)।
প্রতিনিয়ত এভাবেই চলতে থাকে। তবে যখন আমাদের মৃত্যুর সময় আসবে তখন আর পাঠাবেন না বরং আটকে রাখবেন।
যেমন সহীহ বুখারীর একটি হাদিসে এসেছে রসুল (সা:) ঘুমের সময় এই দুআ পড়তেন –
بِاسْمِكَ رَبِّ وَضَعْتُ جَنْبِي وَبِكَ أَرْفَعُهُ، إِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِي فَاغْفِرْ لَهَا، وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ
তোমার নামে আমার পিঠ বিছানায় রাখছি আবার ঘুম থেকে তেমার নামেই উঠবো। যদি ঘুমের মধ্যে আমার নফছ/রূহ/জীবনকে আটকে রাখ তাহলে আমাকে মাফ করে দিও। আর যদি আমাকে আবার পাঠিয়ে দাও তাহলে তোমার নেক বান্দাদেরকে দুনিয়াতে যেভাবে হেফাজত কর, আমাকেও ঠিক তেমনি হেফাজত করো (সহীহ বুখারী ৭৩৯৩)।
বুঝা গেল ঘুমের মধ্যে রূহ আমাদেরকে রেখে রবের সাথে সাক্ষাতে যায়। রুহের অবস্থান আমাদের দেহে কিন্তু তার সম্পর্ক বেশি তার এবং আমাদের রবের সাথে।
রূহ চলে গেলে আমরা মারা যায় না কেন? কারণ শরীর নামক ইঞ্জিন চালু রেখে চলে যায়। যেমন বাস, ট্রাকের ড্রাইভার অনেক সময় গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখে চা-পান খাওয়ার জন্য যায়। ইঞ্জিন চালু থাকে কিন্তু গাড়ি চলে না। আমাদের শরীরের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই ঘটে। তবে শরীরের সাথে রিমোট কন্ট্রোলের মত এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক চালু থাকে।
আরো বুঝতে পারি, রুহের শক্তি বা বলতে পারি চলার গতি এত দ্রুত যা আমাদের কল্পনা সীমার বাইরে। যখন কেউ আমাদেরকে ঘুমের থেকে ডাক দেয় তখন শরীরের সাথে নেটওয়ার্ক বাকি থাকার করণে সাথে সাথে রুহের কাছে সিগনাল চলে যায়, তাই সাথে সাথে সে দ্রুত আবার আমদের শরীরে প্রবেশ করে ইঞ্জিনগুলো একটিভ করে। এই দ্রুত গতির পরিমাণ আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। ঘুম থেকে উঠার ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের সাথে এমন হয়ে থাকে, তাই আলাদা করে বুঝানোর দরকার নেই। কখনো খুব দ্রুত ডাকার কারণে আমরা ঘুম থেকে উঠেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তার মানে রূহ খুব দ্রুত আসার কারণে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এ কারণে ঘুমন্ত ব্যক্তিতে হঠাৎ করে করে ডাকতে, জোরে বা খুব দ্রুত ডাকতে ইসলাম আমাদেরকে নিষেধ করেছে।
আরো বুঝি-রূহ এমন শ্রেণি বা জাতের অন্তর্ভুক্ত যা আমাদের শরীরের উপাদান থেকে আলাদা কিছু যা অনেক পাওয়ারফুল এবং অসম্ভব ক্ষমাতর অধিকারী। আমাদের এই চর্মচোখে আল্লাহকে দেখতে পারিনা এবং তা সম্ভবও না (সুরা আরাফ ১৪৩)।
কিন্তু রূহ আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাৎ লাভ করে। আল্লাহ তা’আলা তাকে কাছে ডাকেন, কখনো আটকে রাখেন আবার কখনো ছেড়ে দেন (বুখারী ৭৩৯৩)।
তাহলে বুঝলাম, রূহ আমাদের শরীরের কিন্তু তার ক্ষমতা আর পাওয়ার আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার গঠন ও বৈশিষ্ট্য এতটাই ভিন্ন যে আমরা তাকে কল্পনার বেষ্টনীতেও আনতে পারি না। নিঃসন্দেহে রূহ আমাদের শরীরের মত মাটির তৈরি না। কারণ মাটি তো স্থুল, রূহ হলো সূক্ষ্ম আর বিজ্ঞান স্বীকৃত যে, স্থুল থেকে সূক্ষ্ম বস্তুর ক্ষমতা বা শক্তি অনেক গুণ বেশি হয়ে থাকে।
তাহলে কিসের তৈরি, কেমন তার আদি অন্ত? এর কিছুই আমাদের জানা নেই এবং কুরআনেও স্পষ্ট কিছু বলা নেই, তবে কিছুটা ইঙ্গিত তো রয়েছে। ইহুদীরা রসুল (সা:) এর কাছে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলো, আল্লাহ তা’আলা তার উত্তর জানিয়ে দেন-
قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
হে নবী আপনি বলে দিন রূহ আল্লাহ একটি নির্দেশ মাত্র, তবে এ ব্যাপারে তোমাদেরকে জ্ঞান অনেক কম দেওয়া হয়েছে (সুরা বনী ইসরাইল ৮৫)।
জানলাম রূহ আল্লাহর নির্দেশ মাত্র। নির্দেশের তো কোন বাহ্যিক বা দৃশ্যমান অস্তিত্ত থাকে না, তাই রুহেরও আলাদা দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। তার আকার আকৃতি বা দেখতে কেমন? সেটাও আমাদেরকে স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে একটা ইশারা দেয়া হয়েছে-
فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ
আদম (আ.) কে বানানোর পর আমি আমার রূহ তার মধ্যে ফুৎকার দিলাম (সুরা সোয়াদ ৭২)।
তার মানে রূহ এমন জিনিস বা শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত যাকে ফুৎকার দেওয়া যায়। তবে রূহ সম্পর্কে আমদের জ্ঞানে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবো না। রুহের ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলে দিয়েছেন-
وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
এব্যাপারে তোমাদের জ্ঞান অনেক কম দেওয়া হয়েছে। তাই এখানেই শেষ করা যাক।
সঠিকটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, ভুলগুলো আমার জিম্মায়।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, ইমদাদুল উলূম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়িগেট, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এমএম/এএজে