খুলনায় মাদক নির্মূলে বিভিন্ন মহল এক সপ্তাহ ধরে সরব হয়েছে। বিএনপি এই প্রথম মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সভা-সমাবেশও করেছে কয়েক দফা। তাদের পরামর্শ পুলিশ তৎপর হলেই মাদক নির্মূল হবে। নগরীর আটটি পয়েন্টকে কেন্দ্র করে এ অপদ্রব্য নির্মূলে কোমর বেঁধে নেমেছে কেএমপি। নগরীর আট থানায় জোরে-সোরে উদ্ধার শুরু হয়েছে।
জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি এবং কেএমপির পৃথক সভায় নগরীর মাদকের হাট বলে খ্যাত আটটি পয়েন্ট চিহ্নিত হয়েছে। পয়েন্টগুলো হচ্ছে- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পার্শ্বের সড়ক, নিরালাস্থ সরকারি এমএমি সিটি কলেজের ছাত্রাবাস, নিরালা, সরকারি মুহাম্মদ মুহসিন কলেজের পার্শ্ববর্তি প্রভাতির মাঠ, জোড়াগেট, টুটপাড়া, রূপসা ও লবণচরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক সভায় বলা হয়েছে, মার্চ মাসে খুলনা জেলায় ৪ কেজি, ২২৭ পিস ইয়াবা, এপ্রিল মাসে ১৩ কেজি গাঁজা, ৮০২ পিস ইয়াবা, ১২৭ বোতল ফেন্সিডিল, যৌন উত্তেজন সিরাপ ২৭ বোতল, দেশী মদ ২৩ লিটার উদ্ধার করা হয়েছে এবং ৪৬ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড দেওয়া হয়। মাদক উদ্ধারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে অনেক কম। মোবাইল কোর্টের সংখ্যা অনেক কম।
অন্যসূত্রে মতে, প্রতিমাসে ভোমরা সীমান্ত, নওয়াপাড়া, চুকনগর, শাহাপুর থেকে প্রতি মাসে কয়েক হাজার বোতল ফেন্সিডিল নগরীর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে আসে। তরুণরা বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা ফেন্সিডিলে আসক্তি হয়ে পড়ে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া তরুণদেরে এক অংশের ভাষ্য, তারা হতাশা থেকে মাদক গ্রহণ করে। ফেন্সিডিল সেবনের পর এক স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। পুরো দিনটাই ঘুমিয়ে কাটায়। এদের কর্মস্পৃহা কমে গেছে। বয়রাস্থ কেএমপির পুলিশ লাইনে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় নগরীর মাদক বিক্রির পয়েন্টগুলো সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সভায় খুলনা সদর, সোনাডাঙ্গা, লবণচরা, হরিণটানা, খালিশপুর, দৌলতপুর, আড়ংঘাটা ও খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মাদক নির্মূলে প্রতিশ্রুতি দেন। পুলিশ কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দারের সভাপতিত্বে এ সভায় মাদক নির্মূল করার তৎপরতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সভায় মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, উদ্ধারের পরিমান বৃদ্ধি এবং মাদকের উৎসগুলো নির্মূল করার জন্য সন্দেহজনক স্থানে অভিযান পরিচালনার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মো. আহসানুর রহমান জানান, তরুণেদের মধ্যে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক পণ্য ক্রয়ে তারা অভিভাবকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। সহপাঠী একে অপরকে মাদক সেবনে উৎসাহিত করে। এখানে গাঁজা ও ইয়াবা সেবনকারীদের সংখ্যাই বেশি।
মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোঃ হুমায়ুন কবিরের উদ্ধৃতি দিয়ে সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, মাদক প্রতিরোধ ও মাদককেন্দ্রিক সবধরণের অপরাধ দমনে মেট্রোপলিটন পুলিশ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিক সক্রিয় রয়েছে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযান পরিচালনা করে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। একই সাথে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অস্ত্র, মাদক ও মাদক বিক্রির অর্থ আটক করা হয়েছে। পুলিশ এসময়ে মাদকের বেশ কিছু স্পট বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মাদক বিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে সুধী সমাবেশ আয়োজন করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভায় জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান জানান, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস, মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশ পৃথকভাবে এপ্রিল মাসে মাদকের বিরুদ্ধে মোট ১ হাজার ৫৬৩টি অভিযান পরিচালনা করে।
মঙ্গলবার বিকালে বিএনপির উদ্যোগে স্থানীয় বৈকালী মোড়ে মাদক প্রতিরোধে মহানগর বিএনপির ধারাবাহিক কর্মসুচির অংশ হিসেবে র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। এ র্যালী পূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহানগর বিএনপির সভাপতি এড. শফিকুল আলম মনা বলেন, মাদকের এই নীল ছোবল থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল- কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
এ সমাবেশে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেন, ভয়ানক নেশা জাতীয় দ্রব্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। এসব মাদকের বেশির ভাগই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার হতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত। দিনদিন যুবসমাজের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চললেও অভিযান চালানো হয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরাপদে মাদক গ্রহণের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাদকের বিরুদ্ধে প্রকৃতঅর্থে যুদ্ধ ঘোষণা করে সমাজ থেকে মাদককে চিরতরে বিলীন করতে হবে। মাদকের কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, নষ্ট হচ্ছে আস্থা-বিশ্বাস, পরিবার ও সমাজে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। মাদক সমস্যার সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন, সব ধর্মীয় নেতা, সুশীল সমাজসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
খুলনা গেজেট/এমএনএস