খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগামীর বাংলাদেশ হবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার : ড. ইউনূস
  জুলাই-আগস্টে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সময় লাগবে : উপদেষ্টা আসিফ

মহাসড়কে আটকা হাজারো মানুষ মহাদুর্ভোগে

গেজেট ডেস্ক

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. সামছুল আলম গত বুধবার কক্সবাজার গিয়েছিলেন। মহাসড়কে পানি ওঠার খবর পেয়ে বেড়ানো অসমাপ্ত রেখেই বৃহস্পতিবার সকালে বাসে করে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। পথে মহাসড়কের কয়েকটি জলমগ্ন অংশ পেরিয়ে বিকেল ৩টায় তাঁদের বাসটি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়ায় পৌঁছে। পানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাসের যাত্রা সেখানেই শেষ হয়।

সারা রাত না খেয়ে পরদিন শুক্রবার সকাল ৭টা পর্যন্ত সেখানেই আটকে থাকার পর হেঁটেই সামনে এগোতে থাকেন সামছুল আলম। ক্রমেই পানি হাঁটু ও কোমর ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত ওঠে। সেই সঙ্গে ছিল তীব্র স্রোত। প্রায় চার ঘণ্টা এভাবে পানি ভেঙে ফেনী সদরের মহিপাল পৌঁছেন সামছুল।

এরপর বিভিন্ন যানবাহনে ভেঙে ভেঙে শুক্রবার দুপুরে কুমিল্লায় পৌঁছেন। বিকেলে খবর নিয়ে জানেন তাঁকে বহনকারী বাসটি তখনো আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে!
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়া থেকে মহিপালের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ছয় কিলোমিটার মহাসড়কই বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে মহাসড়কের যান চলাচল।

তীব্র স্রোতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই মহাসড়ক।

কুমিল্লার বাসিন্দা সামছুল আলমের মতো কয়েক হাজার মানুষ মহাসড়কে চলতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য—এমন ভয়াবহ দুর্ভোগে আগে আর পড়েননি। আর স্থানীয়রা বলছে, মহাসড়কে এমন পানি উঠতে আগে কখনো দেখেনি তারা।

শুক্রবার দুপুরে ভুক্তভোগী মো. সামছুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে হাজারো যাত্রী বিপদের মধ্যে পড়ে।

কয়েক হাজার বাস যেখানে থেমেছে, সেখানেই আটকা পড়ে আছে। আশপাশের বাড়িঘর সব কিছু পানির নিচে। গ্রামের বানভাসি বহু মানুষ তাদের গবাদিপশু নিয়ে মহাসড়কের মাঝখানের ডিভাইডারে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকের সঙ্গে তাঁরও পুরো বৃহস্পতিবার রাত কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে।
সামছুল আলম বলেন, ‘ফেরার সময় দেখেছি স্রোতে অনেক মানুষ ভেসে গেছে। লালপোল এলাকায় এক দম্পতিকে তাদের শিশুসন্তানসহ ভেসে যেতে দেখেছি। কিছুদূর গিয়ে স্বামী-স্ত্রী গাছের সঙ্গে আটকে গেলেও তাঁদের শিশুসন্তানের পরিণতি কী হয়েছে, সেটা বলতে পারব না। আমি কয়েক মিনিট পর চলে এসেছি।’

মহাসড়কে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুই দিক মিলিয়ে অন্তত ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শত শত যানবাহন আটকে রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে আটকে পড়া যানবাহনগুলোর বেশির ভাগই দূরপাল্লার বাস। শতাধিক বাস ও ট্রাক পানি মাড়িয়ে চলতে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া কোথাও কোথাও লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুল্যান্সও দাঁড়িয়ে ছিল দুই দিন ধরে। তীব্র স্রোতের কারণে মহাসড়কের বিভাজকে থাকা অনেক গাছ উপড়ে গেছে। বিভাজকগুলোর মাটিও স্রোতে ভেসে গেছে। এর পরও পানির মধ্যে গবাদিপশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। আশপাশে কোথাও খাবারের দোকান নেই। দু-একটি দোকান যা ছিল, সেগুলোর খাবার বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যেই মানুষজন কাড়াকাড়ি করে কিনে নিয়ে গেছে। আশপাশে শৌচাগার না থাকায় বিশেষ করে নারীরা পড়েন চরম বেকায়দায়। কারণ সব বাড়িঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে।

কক্সবাজার থেকে বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে আটকে পড়া বাসের যাত্রীদের একজন সাদিয়া পুতুল। বুকসমান পানি হেঁটে পার হতে পারবেন না বলে শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়র বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য উল্টোপথে রওনা দেন তিনি। ফেনী থেকে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে অবশেষে গাড়িতে উঠতে পেরেছেন তিনি।

সাদিয়া পুতুল বলেন, ‘জীবনে কখনো এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়িনি। আমাদের বাসে কয়েকজন বন্যার্ত মানুষ উঠেছিল নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে একটি শিশু জ্বরে কাঁপছিল। কিন্তু মা-বাবা শিশুটিকে ওষুধ তো দূরে থাক, একটু খাবারও দিতে পারছিলেন না। বানের পানির কারণে কাছাকাছি কোথাও কোনো ওয়াশরুমও ছিল না। কতটা কষ্ট করেছি তা বলে বোঝাতে পারব না।’

গতকাল শুক্রবার দুপুরে সোহেল রানা নামের আরেক যাত্রী বলেন, পানি কখন কমবে সেই অপেক্ষায় মানুষ সারা দিন সারা রাত বাসে বসে ছিলেন। পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সারি এবং উল্টোপথও বন্ধ হয়ে থাকায় ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে বেশির ভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবল স্রোতের মধ্যে পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

ভুক্তভোগীরা বলে, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই যানবাহনে আটকে পড়া মানুষের মধ্যে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়। রাতে প্রায় প্রতিটি বাসেই শিশুদের খিদায় কাঁদতে দেখা গেছে। অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদের চিকিৎসা বা সহায়তা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না।

গতকাল দুপুরে ফেনী শহরের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী অটোরিকশাচালক দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমার বয়সে কখনো ফেনী শহর বা মহাসড়কে এভাবে পানি উঠতে দেখিনি। পথে এত মানুষ আটকা পড়েছে যে কোনো দোকানে এক প্যাকেট বিস্কুটও ছিল না। আজ সকালে মহিপাল এলাকায় স্বেচ্ছাসেবীদের মানুষের জন্য শুকনা খাবার নিয়ে আসতে দেখেছি।’

শুক্রবার বিকেলে লেমুয়া এলাকায় আটকে থাকা বাসচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এমন দুর্ভোগে জীবনে কখনো পড়ি নাই। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে গাড়ি নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে আজ রাতও এখানেই কাটাতে হবে। কখন ঢাকায় ফিরব বলতে পারছি না। ৪২ জন যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার থেকে এসেছি। এখনো কয়েকজন গাড়িতে বসে আছেন। বাকিরা নিজ দায়িত্বে পানি পার হয়ে চলে গেছেন।’

 

 

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!