চারদিকে কারফিউ চলছে। সবকিছু থমথমে অবস্থা। আমরা কয়েকদিন যাবৎ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করছি। এমন সময় ডিসি ডিবি মহোদয় কন্ট্রোল রুমে ছোটাছুটি শুরু করলেন। মাননীয় পুলিশ কমিশনার জনাব গোলাম মোর্শেদ সাহেব হাজির হলেন। তিনি কয়েকদিন আগে পুলিশ কমিশনার জনাব এনামুল হকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হয়তো জনাব এনামুল হক সাহেব তেমন কঠোর হতে পারছিলেন না। তাই তাঁর আপন ভাই জনাব মোঃ আমিনুল হক এরশাদ সরকারের দাপুটে মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনার জনাব গোলাম মোর্শেদ সাহেবেরও এক ভাই তখন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
যাহোক, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আকস্মিক পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আগমনের খবরে সকলেই তটস্থ হয়ে পড়লেন। ডিসি ডিবি মহোদয় আমাকে ডেকে বললেন, ‘কামরুল মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয় যেকোন সময় কন্ট্রোল রুমে এসে পড়বেন। তুমি যেভাবে পারো ৫০ জনের খাবার ব্যবস্থা কর’।
আমার মাথায় বজ্রপাত হলো। বেশ কয়েকদিন ধরে ঢাকা শহরে কারফিউ চলছে। কত মানুষ মারা গেছে তার হিসেব নেই। শুধু কতজন পুলিশ মারা গেছে বা আহত হয়েছে সেই হিসেব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম বেশি। আন্দোলনকারীরা মারা গেলে মৃতদেহ গোপন করাই ছিল নির্দেশ। এমন পরিস্থিতিতে এক ঘন্টার মধ্যে ৫০ জনের খাবার রেডি করা অনেক কঠিন কাজ। তাও আবার মহামান্য রাষ্ট্রপতির খাবার।
আমি উপায়ান্তর না দেখে কন্ট্রোল রুমে অবস্থানরত তিনটি গাড়ি নিলাম। সামনে পিছনে দুই গাড়ি আর্মড পুলিশ মাঝখানে আমার গাড়ি নিয়ে নিকটস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হাজির হলাম। তাদেরকে অনুরোধ করে ৫০ প্যাকেট উন্নতমানের খাবার নিয়ে কন্ট্রোল রুমে হাজির হলাম। সকল অফিসার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন।
কন্ট্রোল রুমের একটি বিশেষ রুমে আমি খাবার সাজিয়ে রাখলাম। এমন সময় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের স্টাফ অফিসার (নাম গোপন করলাম) মারাত্মক ক্ষুধার্থ অবস্থায় আমার কাছে গিয়ে বললেন, ‘গতকাল থেকে খাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমি এক প্যাকেট খেলাম’।
তিনি আমার কথা শুনার অপেক্ষা না করেই খেয়ে নিলেন। তাঁর খাওয়ার অবস্থা দেখেই আমি তাঁর ক্ষুধা অনুভব করতে পারছিলাম। হঠাৎ করে ডিসি ডিবি মহোদয় রুমে ঢুকে স্টাফ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাউ ফানি’।
আমাকে ধমকের সুরে বললেন, ‘এই রুমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসার আগে কেউ ঢুকবে না’।
এরমধ্যেই সাইরেন বাজাতে বাজাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির গাড়ি বহর কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়লো। তিনি সবার সাথে করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলেন। অসুস্থ হয়েও ডিসি সাউথ মহোদয় কন্ট্রোল রুমেই অবস্থান করছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর সাথে কথা বললেন। ঐদিন তিনি যাকে সামনে পেয়েছিলেন তাঁর সাথেই করমর্দন করেছিলেন। অবশেষে খাবার রুমে গিয়ে সামান্য খাবার মুখে দিয়ে বিদায় নিলেন।
সেদিন অধিকাংশ অফিসার ক্ষুধায় জর্জরিত ছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদায় নেওয়ার পরপরই সকল অফিসার খাবার রুমে ঢুকে পড়লেন। সীমিত খাবার নিয়ে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। তবুও সকলকে খুশি রাখবার চেষ্টা করলাম। এরমধ্যে ডিসি সাউথ ও ডিসি নর্থ মহোদয় একসাথে ঢুকে ডিসি সাউথ সাহেব বললেন, ‘কামরুল জান বাঁচাও, আর পারছিনা’।
ডিসি নর্থ মহোদয় বললেন, ‘আমরা কী এতই খয়রাতি যে এঁটো খাবার খাবো’।
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ডিসি সাউথ মহোদয় বললেন, ‘রাখেন আপনার বাহাদুরি। খেয়ে জান বাঁচানো ফরজ। এই অবস্থায় যা পান তাই খান’।
আমি আবারও বিব্রত হলাম। ডিসি সাউথ মহোদয় খেলেন, কিন্তু ডিসি নর্থ মহোদয় না খেয়ে চলে গেলেন। চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)