সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে পণ্য আমদানীতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বন্দরের দায়িত্বে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যে কারণে ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানীতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে ক্রমশঃ কমছে আমদানির পরিমান। বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনিয়ম দূর্নীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছে বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
ভোমরা বন্দর সংশ্লিষ্ট ৪টি সংগঠন জরুরী সভা করে কমিশনারের নিকট এব্যাপারে একটি অভিযোগ করেছেন। সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশন, সাতক্ষীরা চেম্বার অব কর্মাস, কর্মচারি এ্যাসোসিয়েশনসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ৪টি সংগঠন গত ২৯ অক্টোবর যৌথ সভা করে বন্দরের ডেপুটি কমিশনার মোঃ এনামূল হকের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এসব অভিযোগ করেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সাতক্ষীরা ভোমরা কাস্টমস্ এখন অনিয়ম, দূর্নীতি ও হয়রানির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। প্রতি মাসে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে জোর পূর্বক হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা। বৈধকাগজ পত্র থাকা শর্তেও ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যে বিল অব এন্ট্রি প্রতি পণ্যের প্রকার ভেদে ২ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করছে কাস্টমসের কর্মকর্তারা। প্রতিদিন প্রায় ৮০ থেকে শতাধিক সংখ্যক বিল অব এন্ট্রিতে গড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এতে মাসে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভোমরা কাস্টসসের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। অবৈধ এসব ঘুষের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন আমদানিকারকরা। ফলে ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে পাশ্ববর্তী অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কাস্টমসের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত এই ঘুষের টাকা দিতে গিয়ে লোকসানে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী ভারত থেকে পণ্য আমদানি আপাতত বন্ধ রেখেছেন। এতে করে এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে রাজস্ব আদায়ের উপর। ফলে কাস্টমস্রে হয়রানি ও অনিয়ম বন্ধের জন্য জরুরি ভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানান ব্যবসায়ীরা নেতারা।
ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী নওশাদ দেলওয়ার রাজু, সাধারণ সম্পাদক এএসএম মাকসুদ খান, সাবেক সভাপতি আশরাফুজ্জামান আশু, শেখ এন্টারপ্রাইজের শেখ হাসান হক মোস্তফা ও কর্মচারি এ্যাসোসিয়েশনের মহসিন কবির জানান, আমদানিকৃত ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশকরার পর বিল অব এন্ট্রি করার জন্য কাস্টমস্ অফিসে অগ্রিম ২ হাজার টাকা না দেয়া পর্যন্ত বিল অব এন্ট্রি নাম্বার ফেলতে দেয়া হয় না। পণ্য ভেদে হলুদের ক্ষেত্রে ট্রাক প্রতি ২ হাজার টাকা, শুকনা মরিচের ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রি প্রতি ৩ হাজার টাকা, খৈল সাপটার ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মেট্রিক টনে ১৫ হাজার টাকা, ভুষির ক্ষেত্রে বিল অব এন্টি প্রতি ৫ হাজার টাকা, ভুষি সাপটার ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মেট্রিক টনে ৩০ হাজার টাকা, সিরামিক পণ্যের ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রিপ্রতি পরীক্ষণের ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা এবং পিঁয়াজের ক্ষেত্রে ট্রাক প্রতি ২০০ টাকা জোর পূর্বক আদায় করা হচ্ছে।
ভারতীয় ট্রাক বন্দর থেকে বের করার জন্য প্রতিদিন প্রায় ৪০টির অধিক স্ট্যাম্প জমা দিতে হয়। স্ট্যাম্প প্রতি ডেপুটি কমিশনারকে নগদ ২ হাজার টাকা এবং পরীক্ষণে দায়িত্বেরত কর্মকর্তাকে ৫০০ টাকা প্রদান না করা পর্যন্ত স্ট্যাম্পে সাক্ষর করেন না।
রপ্তানীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেও বিল অব এন্ট্রি প্রতি অগ্রিম এক হাজার টাকা প্রদান না করলে বিল অব এন্ট্রি নাম্বার ফেলতে দেয়া হয়না এবং পণ্যের ডলার মূল্য বাড়ানোর ভয় দেখিয়ে বিল অব এন্ট্রি প্রতি ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবৈধ ভাবে আদায় করা হয়। এসব টাকা উত্তোলনের জন্য নির্ধারিত লোকও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে সরাসরি টাকাগুলো একজন সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তার তত্বাবধায়নে উত্তোলন করেন খুলনার কয়েকজন ব্যক্তি। তাদের হাতে টাকা না পৌছানো পর্যন্ত কোন ফাইল ছাড় হয় না। অফিস চলাকালিন সময়ে এমন একজন ব্যক্তিকে সব সময় কাস্টমস অফিসারদের রুমের সামনে অবস্থান করতে দেখা যায়। পণ্যের ডলার মূল্য বাড়ানোর ভয় দেখিয়ে বিল অব এন্ট্রি সংখ্যা বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য পাথরের ক্ষেত্রে ১০ ট্রাকে একটি এবং অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে ৫ ট্রাকে ১টি বিল অব এন্ট্রি নর্ধারণ করে দিয়েছে। যা এ বন্দর প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যবসায়িদের এসব হয়রানির ফলে অনেক ব্যবসায়ি এই বন্দর থেকে মূখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।
আমদানিকারক বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের শাহ আলম শিমূল জানান, সার্কভূক্ত দেশ গুলোতে সাপটার ক্ষেত্রে ডিউটি ফ্রি পণ্য যেমন খৈল ও ভূষি। এ ক্ষেত্রও জোর পূর্বক বিল অব এন্ট্রি প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে সম্পূর্ন অবৈধ ভাবে আদায় করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ন বেআইনি। টাকা না দিলে ফাইলে সাইন করেন না ডেপুটি কমিশনার এনামূল হক। এসব বিষয়ে বেশি কথা কললে ব্যবসায়িদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেন তিনি।
উপরোক্ত অবৈধ টাকা আদায় এবং ডেপুটি কমিশনারের অনিয়ম বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যথায় ভোমরা বন্দরে এ বিষয়ে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং আন্দোলনের প্রক্রিয়া তৈরী হলে ভোমরা সি এন্ড এফএজেন্টস্ এসোসিয়েশন কোন প্রকার দায়ভার গ্রহণ করবে না বলে জানান ব্যবসায়িরা।
সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডস্ট্রিজ’র সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, ভোমরা স্থল বন্দরের ডেপুটি কমিশনারের এনামূল হকের অনিয়ম দূর্নীতি চরম আকার ধারন করেছে। ভারত থেকে পন্য আমদানিকারক ব্যবসায়িরা বিষয়টি তাকে জানিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে খুলনার কাস্টমস কমিশনারকে বিষয়টি অবগত করেছেন। অবিলম্বে তাকে ভোমরা বন্দর থেকে অপসারণসহ ব্যবসায়িদের হয়রানি ও অনিয়ম বন্ধের জোর দাবী জানান।
ভোমরা কাস্টমস’র সামনে থেকে ব্যবসায়ীরদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায়কারী গেবিন্দ চ্যাটার্জী টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তিনি ভোমরা কাস্টমসের একজন নথি সংরক্ষনকারী। তিনি সেখানকার কোন সরকারী বেতন ভুক্ত কর্মচারী নন।
সহকারি কাস্টমস কর্মকর্তা রাজিব হোসেন জানান, এখানে কোন দুর্নীতি হয় না। কেউ যদি তাদের নাম করে ঘুষ নেয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে তাকে কোন হয়রানি হতে হবে না। তিনি আরো জানান, তারা সেবা দিতে আসছেন, সেবা দিয়ে যাবেন।
এ সব বিষয়ে ডেপুটি কমিশনার মোঃ এনামুল হক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পণ্য আমদানী-রপ্তানীর ক্ষেত্রে স্কেলে এখন জিরোটলারেন্সনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যে কারণে ব্যবসায়িরা অবৈধ সুযোগ না পেয়ে এসব অভিযোগ তুলছেন। তিনি আরো জানান, তিনি যোগদানের পর থেকে রাজস্ব আদায় দ্বিগুন হয়েছে।
খুলনা গেজেট/কেডি