মাঝিরা বৈঠা চালিয়ে প্রাণপণ ছুটে চলেন। ঝাঁজ, কাঁসি বাজিয়ে শব্দ করে নৌকার দলনেতা সতীর্থদের উৎসাহ জোগান। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নানা বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে এগিয়ে চলে নৌকা। নৌকাবাইচের সরু ও লম্বাটে নৌকাগুলো ভৈরব নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। যা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন ভৈরব নদের দুই পাড়ের মানুষ। ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ তারা উপভোগ করেছেন নেচে-গেয়ে, আনন্দ-উল্লাস করে।
শুক্রবার (১১ নভেম্বর) ২টার সময় যশোরের অভয়নগরে নওয়াপাড়া ভৈরব নদীতে অনুষ্ঠিত বাইচে লাক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল। বাইচ শুরুর আগেই ভৈরব নদের ওয়াকওয়েসহ দুই নদীর তীর মানুষের ভিড় দেখা যায়। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, ছোট বড় অসংখ্য নৌকা এবং নদীর পাড়ে ভবনের ছাদে উঠে লক্ষাধিক মানুষ বাইচ উপভোগ করেন। পাওয়ার প্লান্ট ঘাট এলাকা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে নওয়াপাড়া ফেরিঘাট মঞ্চের এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় আনন্দঘন পরিবেশ। নানা রঙের পোশাকে বাইচে অংশ নেন প্রতিযোগীরা। ঢাকঢোলসহ নানা বাদ্যের তালে তালে ছিল সারিগান। নানা বর্ণে, আনন্দে-উল্লাসে বেশ জমে ওঠে বাইচ। দূর-দূরান্ত থেকে নৌকাবাইচ দেখতে আসা দর্শনার্থীরা দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ এবং দুপুরের খাবার শেষে প্রতিযোগিতা দেখতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নদীর দু’পাড়ের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। নৌকা বাইচ দেখতে আসা আব্দুর রশিদ, হাকিম শেখ, ইদ্রিস মোল্যা, রুবেল হোসেন কালবেলাকে বলেন, মহামারিকালে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল এ আয়োজন। তাই এমন আয়োজন দেখতে এসেছি।
তার মতো নৌকাবাইচ দেখতে আসা বেশ কয়েকজন দর্শক জানান, এবার ভালো আয়োজন হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী নির্মল সুস্থধারার এ নৌকাবাইচ দেখে দারুণ মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছরের মত এবারও অভয়নগরে ভৈরব নদীতে ১১ তম নৌকা বাইচ’ অনুষ্ঠিত হয়। নওয়াপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে এবং আফিল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয় এ বাইচ। দুপুর ২টায় তালতলা পাওয়ার প্ল্যান্টে বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন ঘোষণা করেন। আফিল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ৮৫ যশোর ১ আসনের সংসদ সদস্য সেখ আফিল উদ্দিন। পরে তালতলা পাওয়ার প্লান্ট ঘাট এলাকা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে নওয়াপাড়া ফেরিঘাট মঞ্চের পর্যন্ত বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। নৌকা বাইচ দল গুলো হল খুলনার তেরখাদা, দিঘলিয়া, কয়রা, নড়াইল ফদিপুরের আলফাডাঙ্গা ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়সহা ৮টি দল অংশ নেয়। এ সময় বাইচ নির্বিঘ্ন করতে নদীতে থানা পুলিশ, নৌ পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দেয়।
বাইচ শেষে বিজয়ী প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী বাইচ দলকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার ছিল ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৪০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পুরস্কার ছিল ৩০ হাজার টাকা। প্রথম হয়েছে খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সোনার বাংলা নৌকা, দ্বিতীয় খুলনা জেলা তেরখাদা উপজেলার ভাই ভাই জলপরী নৌকা, তৃতীয় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার জয় মা দূর্গা নৌকা। এছাড়াও গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার মা শিতলা নৌকা, জয় মা কালি নৌকা, ফরিদপুরের আলফা ডাঙ্গা এলাকার বাংলার বাঘ নৌকা তুষরাইল এলাকার মায়ের দোয়া নৌকা, নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার আল্লার দান নৌকা অংশ গ্রহণ করে। তাদেরকে স্বান্তনা পুরষ্কার দেয়া হয়।
এর আগে নৌকা বাইচ উপলক্ষে সকালে উপজেলাতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। নওয়াপাড়া পৌর সভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাসের সভাপতিত্বে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মো: তমিজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের এমডি মো: মনিরুল মওলা ।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা আ’লীগের সভাপতি এনামুল হক বাবুল, সাধারণ সম্পাদক সরদার অলিয়ার রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবাহ উদ্দিন, সহকারী কমিশনার ভুমি থান্দার কামরুজ্জামান, থানা অফিসার ইনর্চাজ একেএম শামীম হাসান, নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মইনুরজহুর মুকুলসহ অন্যান্যে নেতৃবৃন্দরা।
খুলনা গেজেট/ টি আই