আজ রবিবার (৬ জুলাই) দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সংস্কারক এস.এম.এ. মজিদের ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। খুলনার ইতিহাসে যাঁর নাম লেখা আছে সাহস, প্রজ্ঞা, ত্যাগ আর মানবিকতার অমলিন স্বর্ণাক্ষরে। সেই মহান কর্মবীরকে আজকের প্রজন্ম প্রায় ভুলতে বসেছে। অথচ তাঁর প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজও আলো ছড়াচ্ছে খুলনার প্রতিটি প্রান্তে।
খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার বারাসাত গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী ফকির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহ মোস্তফা আহমদ মজিদ। তাঁর বাবা শাহ মোবারক আলী ছিলেন নড়াইল এস্টেটের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল এবং খুলনা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পাস করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। ছাত্রজীবনে বেকার হোস্টেলে অবস্থানকালে দারিদ্র্যপীড়িত সহপাঠীদের সহায়তায় নিজের অর্থ ব্যয় করতে কখনো দ্বিধা করেননি।
কলেজে পড়াকালীন সময়েই তিনি যুক্ত হন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৩৬ সালে গঠিত ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন’- এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালের মোহাম্মদ আলী পার্ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি, যেখানে এ.কে. ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতা ও নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত করেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগে খুলনা ভারতভুক্ত হওয়ার খবর শোনার পর মুসলমান সমাজে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। এস.এম.এ. মজিদ তাঁর মৌলবীপাড়া বাসভবনে বসে বাউন্ডারি কমিশনে মামলা দায়েরের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রস্তুত করেন। তাঁর নেতৃত্বে ও এ.কে. ফজলুল হকের সহায়তায় ১৮ আগস্ট কোলকাতা বেতারে ঘোষণা আসে যে খুলনা-যশোর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। খুলনা-যশোর যদি সেদিন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত না হতো, তাহলে আজকের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইতিহাসই ভিন্ন হতো।
দেশ বিভাগের পর শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল যুগান্তকারী। জেলা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে খুলনার শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আজম খান কমার্স কলেজ, খুলনা সিটি কলেজ, খুলনা ল’ কলেজ, তেরখাদা নর্থ খুলনা কলেজ, শহীদপুর খান এ সবুর হাই স্কুল, নর্থ খুলনা হাই স্কুল (নিজ পৈত্রিক সম্পত্তিতে) সহ বহু প্রতিষ্ঠান। তাঁর মায়ের ও ভাইয়ের নামে বারাসাত গ্রামে গড়ে তোলেন দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
রাজনীতির মাঠে বারবার প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও জনসেবা থেকে পিছু হটেননি। ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে পরাজিত হলেও পরে বৃহত্তর খুলনা থেকে বিপুল ভোটে এম.এন.এ নির্বাচিত হন।
ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজের জন্য কিছু রাখেননি তিনি। খুলনায় স্ত্রীর ও কন্যার জন্য একটি জমিও রেখে যাননি। তাঁর জীবন ছিল নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও মানবকল্যাণে উৎসর্গিত।
১৯৬৮ সালের ৬ জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রাত সাড়ে ১০ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ৭ জুলাই খুলনার টুটপাড়া কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
খুলনা গেজেট/এএজে