ভালোবাসা দিবসে গদখালীর চাষীরা এবার উপহার দিচ্ছেন শীত প্রধান দেশ নেদারল্যান্ডের ফুল টিউলিপ। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে এখন প্রাণবন্ত ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী বাজার। এ বাজার ও পার্শ্ববর্তী পানিসারা ইউনিয়ন বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ ভিড় করছেন নতুন এসব ফুল ও চাষাবাদ দেখার জন্য।
এ বছর তিনটি দিবসকে কেন্দ্র করে যশোরে ফুলের বাজার চাঙ্গা হওয়ায় প্রায় দুই বছর পর হাসি ফুটেছে গদখালীর ফুল চাষীদের মুখে। তারা আশা করছেন গত দুই বছর করোনায় লাগাতার যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন, এ বছর ফুল বিক্রি করে তা কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। গদখালীতে এখন সব ফুলের দাম দ্বিগুণ। মানভেদে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়, যা মাসখানেক আগেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩ থকে ৫ টাকায়। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে ৮-১২ টাকায়। এছাড়া গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ৫শ’-৭শ’ টাকা। যা আগে ছিল ২শ’-৩শ’ টাকা।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যানুযায়ী, যশোরে ফুলচাষী রয়েছেন প্রায় ছয় হাজার। ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুলের চাষ হয়। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলা ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠে ১১ ধরনের ফুল উৎপাদন করেন চাষীরা। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে গ্লাডিওলাস, লিলিয়াম, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, ক্লোনডালা, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরণের ফুল শোভা পাচ্ছে। তবে সম্প্রতি শীত প্রধান দেশের ফুল টিউলিপ চাষের মাধ্যমে গদখালীতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস ঘিরে প্রতি বছরই গদখালীর ফুলচাষীরা নতুন জাতের ফুল উপহার দিয়ে থাকেন। গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, লংস্টিক রোজের পর এবারের ভালোবাসা দিবসে ফুলপ্রেমীদের জন্য নতুন ফুল হিসেবে এখানকার চাষীরা উপহার দিচ্ছেন টিউলিপ।
এলাকায় উৎপাদিত এসব ফুল দেশের বৃহত্তম ফুলের বাজার গদখালীতে বিক্রি হয়।
গদখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কাকডাকা ভোর থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরব ফুলের বাজার। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ফুলের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শত শত ফুলচাষী। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, বগুড়া ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফুলের দাম নিয়ে হাঁক-ডাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। দু’দিন ধরে ফুলের চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দিনের চেয়ে শনিবার এ বাজার থেকে বেশি ফুল কিনছেন। একই সঙ্গে বেশি দাম পাওয়ায় ফুলচাষীরাও বাজারে দ্বিগুণ ফুল নিয়ে এসছেন। সব মিলিয়ে উৎসবের এ মাসে আবারো ফুল বেচাকেনা জমে ওঠায় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের মনে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
গদখালীর পানিসরা গ্রামে নেদারল্যান্ডের টিউলিপ চাষ করেছেন ইসমাইল হোসেন। নতুন ফুল চাষের নেশা থেকে তার টিউলিপ চাষে উৎসাহ জাগে। প্রথমবারের মতো তার পাঁচ শতক জমিতে ফুটেছে বিভিন্ন রঙের সাত প্রকারের টিউলিপ ফুল। তিনি জানান, ৬ জানুয়ারি বীজ রোপণ করার পর ১৮-২০ দিন পর কুঁড়ি আসা শুরু করে। ২৫ দিনের ভেতরে তার জমিতে টিউলিপ ফোটা শুরু করেছে। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তিনি টিউলিপ বিক্রিও করেছেন। প্রতি পিছের মূল্য পেয়েছেন ১২০ টাকা। করোনা আর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের রেশ কাটিয়ে উঠে চাষীরা আশার আলো দেখছিলেন। তবে অসময়ের বৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রজাতির অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও বর্তমানে ফুলের যে দাম তিন দিবসে সব ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন বলে তিনি আশাবাদী।
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশের মাটিতে নেদারল্যান্ডের টিউলিপ দেখতে আসছেন নানা বয়েসি ফুলপ্রেমীরা। তাদের জন্য এন্ট্রি ফি ধরা হয়েছে মাথাপিছু ৫০ টাকা।
ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসরা গ্রামের আজিজুর রহমান, নাসরিন আক্তার, মীর ফয়েজ আলী, ইমামুল হোসেন ও গদখালী গ্রামের লিয়াকত আলী লিলিয়াম ফুলের চাষ করছেন। আজিজুর রহমান জানান , তিনি সর্বপ্রথম ৫৯টি বীজ রোপণের মাধ্যমে লিলিয়াম চাষ শুরু করেন। প্রতিটি বীজের মূল্য ৭০-৮০ টাকা। বর্তমানে তিনি এক বিঘা জমিতে লিলিয়াম বীজ রোপণ করেছেন। সব গাছে কুঁড়ি এসেছে, তবে ভালবাসা দিবসে ফুল সরবরাহ করতে না পারলেও মাতৃভাষা দিবসে তিনি এ ফুল বিক্রি করতে পারবেন। প্রতিটি লিলিয়াম ফুলের দাম ১৫০ টাকা। যশোরের চেয়ে ঢাকায় এ ফুলের চাহিদা বেশি। বীজ রোপণের ৩ মাস পর এ ফুল ফোঁটে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস ভরে, এ ফুলের প্রচুর চাহিদা থাকে। শেড না থাকায় ও বীজের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর একটু পিছিয়ে পড়েছেন আজিজুর রহমান। লিলিয়াম সাদা, হলুদ, কমলা, গোলাপী, লাল, ও বেগুনী বর্ণের হয়। আজিজুর রহমান পিছিয়ে পড়লেও অন্যান্য চাষীরা ভালবাসা দিবসে লিলিয়াম ফুল বিক্রি করতে পারবেন।
গদখালী বাজারে ফুল নিয়ে আসা তরুণ ফুলচাষী ও উদ্যোক্তা আল আমিন হোসেন বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস চলমান। এ সময় ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। বর্তমান বাজারে গোলাপের চাহিদা বেশি, অনেক দিন পর বেচাকেনা অনেক ভালো হচ্ছে। ভালোবাসা দিবস ও বসন্তবরণ উপলক্ষে বিক্রি আরো বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, মহামারি করোনার কারণে ফুলের বাজার বসলেও এতটা প্রাণবন্ত ছিল না।
পানিসরা গ্রামের ফুলচাষী কবির হোসেন বলেন, দুই বিঘা জমিতে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করেছেন। এখন গোলাপের দাম দ্বিগুণ। ফুল দেরিতে ফোটানোর জন্য গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে। এজন্য বাড়তি ৩-৪ টাকা খরচ হচ্ছে। ভালোবাসা দিবসে এই ফুল বিক্রি করতে পারলে সব খরচ উঠে লাভ হবে দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি একাংশের সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, বিভিন্ন কারণে এবার ফেব্রুয়ারিতে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তিন দিবসে অন্তত ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে। তিনি আরও জানান, অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে সব ধরনের ফুলের দাম দ্বিগুণ। এবার ফুল চাষীরা লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এদিকে, গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়ন এখন রীতিমত পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ ফুল ও চাষাবাদ দেখতে এসব স্থানে ভিড় জমাচ্ছে। অবশ্য সুযোগটি গ্রহণ করেছে স্থানীয়রা। তারা ফুল খেতে প্রবেশে রীতিমত এন্ট্রি ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এমনকি খাবারের হোটেলে ঢুকতেও ফি দিতে হচ্ছে দর্শণার্থীদের। যা চাঁদাবাজির পর্যায়ে চলে গেছে বলে অনেক দর্শণার্থী অভিযোগে জানিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এএ