১৯৯৭ সাল। ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে ভারতের অন্যতম জাতীয়তাবাদী সংগঠন জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সেই সুবর্ণজয়ন্তীর সভায় শিশির বসুর একটি কথা আজো অভিভূত করে। শিশির বসু সেদিন বলেছিলেন, কায়েদ-ই-আজম জিন্নাহ দেশ ভাগ করেননি। জাতীয় কংগ্রেসের কিছু নেতার আচরণ তাকে দেশভাগের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে শিশির বসু কিন্তু যে-সে ব্যক্তিত্ব নন। প্রখ্যাত জাতীয় কংগ্রেসের নেতা শরৎ চন্দ্র বসুর সন্তান। আবার তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইপো।
আজকে স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরও মনে হচ্ছে জাতীয়বাদী জিন্নাহ কেন পাকিস্তান বেছে নিয়েছিলেন। যে জিন্নাহ রাজনীতিতে আসেন গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের হাত ধরে, যে জিন্নাহ রাজনীতিতে গান্ধীজী ও নেহেরুজীর অগ্রজ, যে জিন্নাহকে বলা হোত “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত”, সেই জিন্নাহ কেন পাকিস্তান বেছে নিলেন? আজো চলমান ইতিহাসের কাছে এটা লাখ টাকার প্রশ্ন। আমাদের কাছে আরো একটি প্রশ্ন, জিন্নাহ পাকিস্তান কার্যকর করলেও পাকিস্তানের উদ্যাক্তা বা প্রস্তাবক নন। মহাকবি আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন, “সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দোস্তা হামারা হামারা”, সেই ইকবালও পাকিস্তানকে তার কাব্য- অনুষঙ্গে ঠাঁই দেন। তবে তার সেই ‘পাকিস্তান’ ছিল ‘পবিত্র ভূমি’।
প্রকৃত পাকিস্তানের প্রস্তাবক ব্যারিস্টার খান রহমত আলী খান। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বললেলও আধুনিক ইতিহাসবিদরা কিন্তু বলতে চাইছেন ফজলুল হকের প্রস্তাবের মধ্যে ‘পাকিস্তান’ ছিল না। এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, কিরণ শঙ্কর রায় ও শরৎচন্দ্র বসুরা কিন্তু স্বাধীন বঙ্গভূমি চেয়েছিলেন। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম প্রাধান্য থাকায় শ্যামা প্রসাদের হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস বাংলা ভাগটাই চেয়েছিল।
কমিউনিস্ট পার্টির তিন সদস্য জ্যোতি বসু, রতন লাল ব্রাহ্মণ ও সত্য নারায়ণ রায়রা বাংলা ভাগের পক্ষেই ভোট দেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কংগ্রেসের মধ্যে নেতাজী সুভাষ, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায়, সরোজিনী নাইডু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বা পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা ছিলেন, তেমনি এই দলের মধ্যে মতিলাল নেহেরু, লালা লাজপত রায়, বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পালের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতারা ছিলেন। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীই কিন্তু ‘রাম রাজত্ব’-র কথা বলতেন। এখন সেটা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন রেভারে- উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি খ্রিস্টান। এছাড়া বদরুদ্দিন তৈয়ব, হাকিম আজমল খান, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো রাজনীতিকরা জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। কিন্তু তারপরও কংগ্রেসের একাংশ ছিল চরম হিন্দুত্ববাদী। তাদের আচরণ এবং কংগ্রেসের মুসলিম স্বার্থকে উপেক্ষা করার জন্যই কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর বাসভবনে তৈরি হল মুসলিম লীগ। এই মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র প্রণেতা ছিলেন কিন্তু এ কে ফজলুল হক। পরে মতবিরোধ ঘটলে তিনি কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন। আবার পরে মুসলীম লীগে যোগ দেন।
১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে আমরা কী দেখলাম। একের পর এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে সংগঠিত করেছে। যাতে মুসলিমরা দেশ ছেড়ে পালায়। ১৯৬৪ সালের কলকাতা দাঙ্গা সব হিসাবকে পাল্টে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত মুসলিমরা আতঙ্কে পূর্ব পাকিস্তান চলে যায়। ভাগলপুর, সুরাট, মুম্বই, গুজরাট গণহত্যা, মজফ্ফরপুর থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষমতাসীনদের সংগঠিত দাঙা মুসলিমদের কাছে একটা উদ্বেগ।
আমাদেরকে এত কিছুর পরও স্বীকার করতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু চাকুরির ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। জরুরি অবস্থা নিয়ে যাই বলা হোক না কেন, এক্ষেত্রে সিদ্ধার্থের জমানা বলা যায় ‘আলোর ঝলকানি’। কংগ্রেস জমানায় বিধান রায়ের আমল কিন্তু অন্য কথা বলে। আর পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭-২০১১ সাল পর্যন্ত সিদ্ধার্থের জমানার প্রায় ১০শতাংশ চাকুরি কমে ৩.৫ শতাংশে ঠেকল, যা ২০০৬ সালের সাচার রিপোর্ট স্পষ্ট করে। আর এখন পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের চাকুরি পরিস্থিতি না বলাই ভালো। এম্পাওয়ার ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন বা অ্যাসোসিয়েশন স্নাপস নামে দুটি সংগঠন এই সমীক্ষা চালায়। তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ। এই অবস্থার জন্য শুধু সাম্প্রদায়িক দলগুলিকে দায়ি করা যায় না। তার জন্য তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি তাদের দায় এড়াতে পারে না।
আজকে আসামে এই আই ইউ ডি এফ কিংবা আসাদুদ্দিন ওয়াইসির মিম কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। মুসলিম ভোট বরাবর ছিল রাজনৈতিক। সেই ভোট কিন্তু আজ প্র-মুসলিম সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের দিকে চলে যাচ্ছে। ভারতে আজ দলিত-মুসলিমদের স্বার্থবাহী সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া বা সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গড়ে উঠেছে। এই সংগঠন দক্ষিণ ভারতে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। এটাই বাস্তবতা।
১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময়ে জাতীয় কংগ্রেস মহারাষ্ট্রে আব্দুর রহমান আন্তুলে, রাজস্থানে বদরুদ্দোজা, আসামে আনোয়ারা তৈমুর, বিহারে আব্দুল গোফুর এবং মণিপুরে আলিমুদ্দিন আহমেদকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে ঠিকই। কিন্তু নরম সাম্প্রদায়িকতা থেকে সেও উর্ত্তীর্ণ হতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানার ৩৪ বছর দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা চাকুরি- বাকরির ক্ষেত্রে সেই স্বদিচ্ছা দেখাতে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি কোথাও নরম, কোথাও সূক্ষ্ম, আবার কোথাও অতি নাটকীয় ধর্মনিরপেক্ষতার খেলা করেছে। তার ফলে মিম বা সমকক্ষ মুসলিম সংগঠনগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
খুলনা গেজেট / এমএম