খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪৫
  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

ভারতের পর্যটন কেন্দ্র লাক্ষাদ্বীপে অশান্তির বীজ

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা

লাক্ষাদ্বীপ, ভারতের জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে এক অমূল্য সম্পদ। মাত্র ৬০ হাজারের কিছু বেশি মানুষ এই দ্বীপরাজ্যে বসবাস করে, যাদের অধিকাংশই গরিব মৎসজীবী। দেশের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন রাজ্য তথা টেরিটরি, ৯৬% নারীশিক্ষা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ, জন্মহার দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম এবং দেশের সবচেয়ে কম অপরাধপ্রবণ অঞ্চল। এমন একটা শান্তিপ্রিয় অঞ্চল প্রায় রাতারাতি নরকগুলজারে পরিণত হয়েছে।

লাক্ষাদ্বীপ দেশের ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একটি, কেরালার মূল ভূ-খণ্ড মালাবার উপকূল থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। লাক্ষাদ্বীপে ১টি মাত্র জেলা রয়েছে, সেটিই একমাত্র লোকসভা আসন। লাক্ষাদ্বীপের রাজধানীর নাম কাভারাত্তি, সবচেয়ে বড় শহর এ্যান্ড্রট। অসংখ্য মৃত প্রবাল কীটের দেহাবশেষ সঞ্চিত হয়ে সমুদ্র মধ্যে এই দ্বীপসমূহের সৃষ্টি হয়েছে বলে এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘প্রবাল দ্বীপ’ও বলা হয়ে থাকে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপার্থিব চোখজুড়ানো, আর এটাতেই এখন পুঁজিবাদী হাঙরদের দৃষ্টি পড়েছে।

হঠাৎ লাক্ষাদ্বীপ কেন শিরোনামে ?

রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে, রাজ্যসভার সিপিআইএম সাংসদ ইলামারাম করিমের লেখা একটা চিঠিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। চিঠিতে রয়েছে, কীভাবে সরকার লাক্ষাদ্বীপে সাম্প্রদায়িক অশান্তির বীজ বপন করে সেখানের মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে ও তাদের উপরে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। যাতে করে দ্বীপের অধিবাসীরা দ্বীপ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সকল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে প্রশাসক হিসাবে আইএএস/আইপিএস অফিসারদেরই নিয়োগ দেওয়া হতো, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসেই এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায়। ‘দমন ও দিউ’ এর প্রশাসক হিসাবে গুজরাট বিজেপির নেতাকে প্রশাসক পদে নিযুক্ত করে, ২০১৬ সালে সেই ব্যক্তিকেই ‘দাদরা, নগর ও হাভেলির’ও প্রশাসক পদে বসিয়ে দেয়া হয়। নেতাটির নাম ‘প্রফুল্ল খোদা প্যাটেল’।

২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর এই প্রফুল্ল প্যাটেলকেই লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক পদে নিযুক্ত করা হয়। এমনিতেই এই সব কেন্দ্রশাসিত রাজ্যগুলোতে গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে নিজেদের প্রশাসক বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই, কারণ এদের কোনো বিধানসভা নেই। এভাবেই ভারতের পশ্চিম তীরের সবকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে কার্যত একজন গুজরাটি আরএসএস নেতার হাতে তুলে দেওয়া সম্পন্ন হয়। অতঃপর দীর্ঘ ৬ মাসের প্রচেষ্টায় লাক্ষাদ্বীপ কার্যত: নরকে পরিণত হয়েছে।

প্রফুল্ল প্যাটেল, লাক্ষাদ্বীপে এমন কিছু জনবিরোধী আইন লাগু করেছেন সাদা চোখে যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। পাতি বাংলায় একলাইনে বললে যা দাঁড়ায়- ৯৭% মুসলিম অধ্যুষিত এই দ্বীপরাজ্যে কঠোর হিন্দুত্ববাদী আইন বলবৎ করেছে। যাতে মুসলিমরা উচ্ছেদ হয়ে যায়, আর সেই জমিতে সিলেক্টিভ গুজরাটি বেনিয়ারা হোটেল রিসোর্ট বানাতে পারে।

সিপিআইএম সাংসদ, করিমের চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে- ‘রিফর্ম ও ডেভলপমেন্ট’ এর নাম করে দ্বীপজ মানুষের ঐতিহ্যবাহী যে সংস্কৃতি, তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে বিজেপি। এরই ধারাবাহিকতায় লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র সাংসদ, এনসিপি এর মহম্মদ ফয়জলও রাষ্ট্রপতিকে লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছেন- প্রশাসক প্রফুল্ল প্যাটেলের এই নীতির বিরোধিতা করার জন্য ৩০০ সরকারি কর্মীকে সাসপেন্ড তথা ছাঁটাই করা হয়েছে বিগত ৫ মাসে।

কী আইন প্রণয়ন করেছে ?

১) যেহেতু বিধানসভা নেই, তাই পঞ্চায়েতের হাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পশুপালন ও মৎস দপ্তর পরিচালনের ভার ছিল, সেগুলো কেড়ে নিয়ে প্রশাসকের এখতিয়ারে কুক্ষিগত করেছে প্যাটেল। স্থানীয় মানুষের হাত থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।

২) যাদের দুটোর বেশি সন্তান আছে কিম্বা যারা তৃতীয় বা ততোধিক সন্তান- তারা নির্বাচনে লড়তে পারবে না। এর দ্বারা ৯৮% স্থানীয় নেতা-নেত্রীকে রাজনীতির ময়দান থেকে বাতিল করে দেওয়া গেছে। অথচ দেশের ৩০৩ জন বিজেপি এমপি’র মধ্যে ৯৬ জনেরই তিনটে সন্তান আছে।

৩) ৯৭% মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে গোমাংস নিষিদ্ধ করেছে, কেউ গোমাংস সমেত ধরা পড়লে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন এনেছে। মালায়লি সংস্কৃতিতে সর্বধর্ম নির্বিশেষে গোমাংস বৈধ।

৪) মদের উপরে এতদিন নানান রেস্ট্রিকশন ছিল দ্বীপরাজ্যটিতে, সেটা তুলে নিয়ে- মদ থেকে যাতে বেশি রাজস্ব আদায় হয় তার উপরে জোর প্রচুর বার খোলা হয়েছে, এবং মদ খেতে একপ্রকার বাধ্য করা হচ্ছে অবৈধভাবে স্থানীয় পুলিশকে ব্যবহার করে। প্রসঙ্গত: প্রফুল্ল প্যাটেলের নিজের রাজ্য গুজরাটে মদ নিষিদ্ধ।

৫) সকল সরকারি অফিসসহ স্কুল-কলেজে সমস্ত ধরনের ‘ননভেজ’ খাদ্য আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। একটা দ্বীপরাজ্যে যেখানে সি-ফুডই তাদের মূখ্য খাদ্য- তারা সেই মাছটুকুও খেতে পারবে না।

৬) ‘লাক্ষাদ্বীপ ডেভলপমেন্ট অথোরিটি রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০২১ (LDAR) বলে দ্বীপের যে কোনো ব্যক্তিকে তার ভূমি থেকে উচ্ছেদ বা রিলোকেট করে দিতে পারবে সরকার, বিনা নোটিশে ও বিনা ক্ষতিপূরণে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মামলা পর্যন্ত করতে পারবে না।

৭) ‘প্রিভেনশন অফ অ্যান্টিসোস্যাল অ্যাক্টিভিটিস (PASA)’ নামের একটা নতুন ‘গুণ্ডা আইন’ লাগু করেছে, যার দ্বারা সরকার যে কোনো ব্যক্তিকে জাস্ট হাপিস করে দিলেও, ব্যক্তিটির পরিবারকে ১ বছর পর্যন্ত জানাতে বাধ্য নয়- সেই ব্যক্তি কোথায় আছে বা তার অপরাধ কী? এই সময় সেই ব্যক্তি কোনো রকম আদালত তথা আইনি সুরক্ষা পাবে না।

অর্থাৎ, আপনি গোমাংস খেলেন কি না খেলেন, মদ খেলেন কি না খেলেন- আপনাকে এই ছুঁতোতে LDAR আইন দ্বারা আপনার সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করে দেবে। এবারে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার দরুন আপনি যদি প্রতিবাদ করেন, কিম্বা শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে যদি প্রতিবাদ আন্দোলন করেন- তাহলে আপনাকে PASA আইন দিয়ে জাস্ট গায়েব করে দেবে রাষ্ট্র। আপনি আইনি সহায়তাটুকুও পাবেন না, না আপনার পরিবার জানতে পারবে আপনি কোথায় আছেন!

প্রসঙ্গত: প্যাটেল দায়িত্ব নিয়ে আসার ১ মাস পর পর্যন্ত লাক্ষাদ্বীপ ছিল করোনামুক্ত অঞ্চল, ২০২০ সালে সেখানে কোনো করোনা রোগী ছিল না। এর পরেই আইসোলেশন প্রথা তুলে দিয়ে বিচিত্র সব আইন প্রণয়ন করে প্যাটেল, পাশাপাশি গোমাংস ও মাছ বন্ধ করে দিতেই গরিব মানুষের সস্তার প্রোটিনের অভাব ঘটে, যথারীতি ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ নাগাদ দ্বীপের প্রথম করোনাক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। এ পর্যন্ত সেখনে ৬৬১১টি করোনা রোগী পাওয়া গেছে, যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি, যার মধ্যে ২০৫০টি অ্যাক্টিভ। যেখানে করোনার প্রথম ওয়েভে একজনও মারা যায়নি, সেখানে দ্বিতীয় ওয়েভে ২৪ জন মারা গেছে। আক্ষরিক অর্থে সেখানে মহামারী চলছে বা প্যাটেলের নেতৃত্বে করোনার চাষ করা হচ্ছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, যাতে দ্বীপটি দ্রুত জনশূন্য হয়ে পড়ে।

প্যাটেল খুব চতুরতার সাথে গোটা দ্বীপরাজ্য থেকে স্থানীয় মালায়লি ব্যবসায়ীদের বিতাড়িত করে সেখানে পেটোয়া গুজরাটি বেনিয়াদের বসিয়ে দিচ্ছেন। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে গুজরাটি রিয়েল এস্টেট চক্রকে অবৈধ নির্মাণের ছাড়পত্র দিয়ে লাক্ষাদ্বীপের বাস্তুতন্ত্রকে চরম ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!