বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও অমাবস্যার কারনে নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির চাপে ঘুর্নিঝড় আম্পান আঘাতের ৩ মাস পূর্তির দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সদ্যনির্মিত রিংবাঁধ ভেঙ্গে ও আগের ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে সাতক্ষীরার আশাশুনির তিনটি ও শ্যামনগর উপজেলার একটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে মৎস্য ঘের, ফসলের ক্ষেত ও ইটভাটা। প্লাবিত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ফলে এসব ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন।
গত ২০ মে ঘুর্নিঝড় আম্ফানের তান্ডবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা সদর, শ্রীউলা, প্রতাপনগর, আনুলিয়া, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ ও কালিগঞ্জ উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের হাজার হাজার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। সেই থেকে প্লাবিত এলাকার মানুষ পানিতে ডুবে মানবেতর জীবন যাপন করে আাসছে। কয়েকটি স্থানের বাঁধ সংস্কারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এগিয়ে আসলেও গত ঈদুল আযহার পূর্বে তারা চলে গেছেন। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বাঁধ রক্ষার্থে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক এলাকা রিং বাঁধ দিয়ে রক্ষা করা হয়। ভেঙ্গে যাওয়া মূল বাঁধেও ইতোমধ্যে কাজ করা হয়েছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত এসব ইউনিয়নের কিছু অংশের মানুষ প্রাথমিকভাবে রক্ষা পেয়েছিল।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও অমাবস্যার কারনে নদ-নদীর পানি ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর জোয়ার অস্বাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির তোড়ে আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের শ্রীপুর, কুড়িকাহুনিয়া, হরিশখালি ও চাকলা এলাকায় পূর্বের ভাঙ্গন পয়েন্টে সদ্য নির্মিত রিং বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে পানি ঢোকা শুরু করে। ফলে প্রতাপনগর হাই স্কুলের পেছনে কার্লভাটের পাশের কার্পেটিং সড়ক ভেঙ্গে এলাকায় প্রবল বেগে পানি ঢুকে ইউনিয়নের আরো নতুন এলাকা প্লাবিত করে। এতে করে প্রতাপনগর, কল্যানপুর, লষ্কারি খাজরা, নাকনাসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে ইরিনা ব্রিকস্ নামের একটি ইটভাটা ও এর আশেপাশের সব চিংড়ি ঘের। গোয়ালডাঙ্গা-প্রতাপনগর মেইন সড়কের প্রতাপনগর অংশের উপর দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলা সদরের সাথে প্রতাপনগর ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ হুমকীর মুখে পড়েছে।
এদিকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও গত ২০ মে আম্পানের প্রভাবে ভেঙ্গে যাওয়া শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী গ্রামের বেড়িবাঁধ সংষ্কার করা সম্ভব হয়নি। সেনা বাহিনী দায়িত্ব নিয়েও বাঁধ সষ্কার করতে না পেরে কোরবানীর ঈদের সময় তাঁরা এলাকা ত্যাগ করেন। ফলে ওই ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে প্লাবিত এলাকায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটা অব্যহত ছিল। বৃহস্পতিবারে বৃদ্ধি পাওয়া জোয়ারের পানিতে হাজারাখালী, মাড়িয়ালা, কোলা, কলিমাখালী ও লাঙ্গলদাড়িয়া গ্রামের সাথে নতুন করে বকচর, নাকতাড়া, বুড়াখারআটি, রাধারআটি, মহিষকুড়, শ্রীউলা, পুইজালাসহ ইউনিয়নের প্রায় ২২টি গ্রাম কম বেশি প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত।
শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল জানান, খোলপেটুয়া নদীর জোয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় হাজরাখালী ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম সব প্লাবিত হয়েছে। নদীর পানিতে বুড়াখারআটি গ্রামে আমার নিজের বাড়ির নিচতলা ডুবে গেছে। এখন রান্না করেও খেতে পারছিনা। পুকুর ও মাছের ঘের ডুবে আমার নিজের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইউনিয়নের মানুষ তর্বমানে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। বাঁধ সংষ্কারের দাবিতে ইউনিয়নবাসীকে সাথে নিয়ে তিনি মানববন্ধন করবেন বলে জানান।
অপরদিকে আশাশুনি উপজেলা সদরের জেলেখালী-দয়ারঘাট গ্রামের পাউবো’র ভেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর আগে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নেতৃত্বে জেলেখালী-দয়ারঘাট ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে বিশাল এলাকাকে রক্ষা করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুরে জোয়ারের পানির চাপে দয়ারঘাট হ্যাচারি ও স্কুলের সামনের রিংবাঁধ ভেঙ্গে এবং আরো কয়েকটি স্থানের বাঁধ ভেঙ্গে প্রবল গতিতে নদীর পানি ঢুকে আশাশুনি সদরের দক্ষিণ পাড়া, দয়ারঘাট ও জেলেখালী গ্রামে প্লাবিত করেছে।
এদিকে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের নেবুবুনিয়া এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধ পাশের খোলপেটুয়া নদীতে বিলীন হয়ে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত অংশের ছয়টি পয়েন্ট দিয়ে পানির ঢোকা অব্যাহত থাকায় রাতের জোয়ারে নুতন নুতন এলাকা জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়া বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে এলাকায় নদীর পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলার দুর্গাবাটি ও পোড়া কাটলা এবং পদ্মপুকুরের বন্যতলার বাঁেধর অবস্থাও বেশ ঝুকিপূর্ণ বলে জানা গেছে।
জ্বলোচ্ছ্বাস আর ঘুর্ণিঝড় আম্পান প্লাবনে আজও ডুবে আছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নের কৃষকের সবুজ ফসল ভরা খেত খামার। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গবাদিপশু, ফসলের ক্ষেত, খামারিদের মাছের খামার সবই ভাসিয়ে দিয়ে নিঃশ্ব করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আম্পান। আজও জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে ভুক্তভোগী প্লাবিত অঞ্চলের মানুষের। বাসগৃহ হারিয়ে টোং বেঁধে বসবাস করছে উপকূলের বিপন্ন শতশত পরিবার। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হচ্ছে। মানবেতর জীবনযাত্রার যেন অন্ত খুঁজে পাচ্ছে না বানভাসি এসব মানুষেরা।
ঘুর্নিঝড় আম্পানের পর থেকে জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জের বানভাসী সব শ্রেণী পেশার হাজার হাজার মানুষ জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পাউবো’র বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধের মাধ্যমে প্লাবিত অবস্থার অবসান ঘটাতে জীবন বাজি রেখে চেষ্টা চালিয়েও শতভাগ সফলতা পায়নি। গত ২০ মে’র পর থেকে দীর্ঘ তিন মাস পর ২০ আগষ্ট বৃহস্পতিবার ফের জোয়ার ভাটার স্রোত ধারার লবণাক্ত পানি বয়ে চলেছে এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের দুয়ারে। বানভাসি এসব মানুষের একটাই প্রশ্ন দুর্বিষহ এ জীবন যাত্রার শেষ হবে কবে?
খুলনা গেজেট/এআইএন