খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

বেঙ্গল গেজেট হতে খুলনা গেজেট

মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই হারিয়ে যায় যখন মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার থাকে না, বাক স্বাধীনতা থাকে না। একথা খুবই সত্য যে যুগে যুগে শাসক তার আধিপত্য কায়েম রাখতে, অপশাসনের দ্বারা সহজে নিপীড়ন, নির্যাতন আর শোষণ চালিয়ে যেতে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করে। মানুষের বাক স্বাধীনতা, সত্য ও ন্যায়সঙ্গত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে বিভিন্ন দমনমূলক আইন জারি করে।

আমার জানি যে, একটি স্বাধীন দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রে শুদ্ধ চর্চার পূর্বশর্ত হল সংবাদপত্র তথা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। অথচ ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনার উষালগ্ন থেকে সরকারের সঙ্গে সংবাদপত্রসেবীদের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাইতো শাসকবর্গ সংবাদপত্র প্রকাশনাকে সুনজরে দেখে না, বরং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করতে তৎপর হয়। সংবাপত্রসেবীদের দমনমূলক আচরণের প্রচুর ঘটনা রয়েছে। এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস ঔপনিবেশিক ভারতে সংবাদপত্র প্রকাশের জন্যে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। জানা যায় যে, তার আবেদন প্রত্যাখ্যানের কারণ ছিল যাতে কোনভাবে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অপশাসনের ও শোষণের নিকৃষ্ট সব খবর লন্ডনের হেড কোয়ার্টারে পত্রিকা আকারে না পৌঁছায়। তাছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে উইলিয়াম বোল্টসকে বিলাতে ফেরৎ পাঠানো হয়।

কিন্তু আগুনকে তো আর ছাই চাপা দিয়ে রাখা যায় না। এক সময় ছাই চাপা আগুনই দাবানলে পরিণত হয়। তাই উইলিয়াম বোল্টস এর সংবাদপত্র প্রকাশের প্রচেষ্টার প্রায় দেড় দশক পরে ব্রিটিশ ভারতে পুনরায় সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যেগ গ্রহণ করেন আর এক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জেমস আগস্টাস হিকি।

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ ভারতীয় সংবাদ প্রবাহের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। এ বছর ২৯ জানুয়ারি জেমস আগস্টাস হিকি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম সংবাদপত্র ‘দি বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করেন। তাইতো জেমস হিকিকে অবিভক্ত ভারতের সংবাদপত্রের জনক বলা হয়। তার বেঙ্গল গেজেটের মাস্ট হেডের নিচে লেখা থাকত- “A Weekly political and commercial paper open to all but influenced by none.”

এরপর পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি ইংরেজী সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ইন্ডিয়া গেজেট (১৭৮০), ক্যালকাটা গেজেট (১৭৮৪), বেঙ্গল জার্নাল (১৭৮৫) ক্যালকাটা ক্রনিকাল (১৭৮৬) এশিয়াটিক মিরর (১৭৮৮) ক্যালকাটা জার্নাল (১৮১৮) উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে আরও কিছু ইংরাজী পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার ফলে বাঙ্গালী সমাজেও সংবাদপত্র ও সাময়িকী পত্রিকার চাহিদা সৃষ্টি হতে থাকে।

বাঙ্গালীর নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা রামমোহন রায় ছিলেন উদার ও প্রগতিশীল চিন্তার জাগ্রত মনের অধিকারী এক মানুষ। তিনি অনুভব করেছিলেন যে হিন্দু সমাজের জীবন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্যে বক্তৃতার চেয়ে সংবাদপত্র ও পত্রিকা অধিকতর শক্তিশালী মাধ্যম। সে কারণে তিনি সংবাদপত্র প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন। তার প্রকাশিত সংবাদপত্র ব্রাহ্মণ সেবধি (১৮২১), সম্বাদ কৌমুদী (১৮২১)। এছাড়াও ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ তিনি মিরাৎ-উল-আখবার নামে ফারসি ভাষায় একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তবে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের প্রেস আইন দ্বারা মিরাৎ-উল-আখবার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবিভক্ত বাংলার নবজাগরণের যুগে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সম্পাদনায় আরও যারা মূল্যবান ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে জয় গোপাল তর্কালঙ্কার, নীলরত্ন হালদার. ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, দক্ষিণা চরণ চট্টপাধ্যায়, ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, প্যারী চাঁদ মিত্র, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, শিশির কুমার ঘোষ, দ্বারকা নাথ ঠাকুর, গৌরী শংকর তর্কবাগীশ, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, প্যারী চরণ সরকার, কেশব চন্দ্র সেন, গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য, হরচন্দ্র রায় এর নাম উল্লেখযোগ্য।

প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে (২ জ্যৈষ্ঠ ১২২৫)। এরপর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে (১০ জ্যৈষ্ঠ ১২২৫) শ্রীরামপুর মিশন থেকে ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিকভাবে আরও যে সব বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ লাভ করে সেগুলি হলো সম্বাদ কৌমুদি (১৮২১ খ্রিস্টাব্দ) সমাচার চন্দ্রিকা (১৮২২) বঙ্গদুত (১৮২৯) সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১) সংবাদ ভাস্কর (১৮৩১) বেঙ্গল স্পেক্টেটর (১৮৪২) তত্ত্বাবোধনী (১৮৪৩), এডুকেশন গেজেট (১৮৫৬), সোম প্রকাশ (১৮৫৮), অমৃতবাজার (১৮৬৮), সুলভ সমাচার (১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ)।

এরপর বাংলার মুসলিম সমাজের ধর্মীয় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূর করার লক্ষ্যে সমকালীন মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজসেবী, মনীষী ও মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা আকরাম এগিয়ে এলেন সংবাদপত্রের জগতে। শুরু হল বাংলা সংবাদপত্রের পথে মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের যাত্রা। সে সময়ের সাহসী মুুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে কাজী আব্দুল খালেক, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজী নজরুল ইসলাম, ফজলুল হক সেলবর্ষী, ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, কবি গোলাম মোস্তফা, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মুনসুর আহমেদ, আব্দুল করিম, সাহিত্যবিশারদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, সৈয়দ ইমদাদ আলী, আকবর উদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, শাহাদাৎ হোসেন, কাজী ইমদাদুল হক, মোহাম্মদ মোদাব্বের এর নাম উল্লেখযোগ্য।

বাংলার মুসলমানদের উদ্যেগে প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘মোহাম্মদি আখবার’। এটি আব্দুল খালেকের সম্পাদনায় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন প্রকাশিত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে যে সব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল- দৈনিক হাবলুল মতিন (১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ) সাপ্তাহিক মোহাম্মদী (১৯১০) আল এছলাম (১৯১৪), সাপ্তাহিক আহলে হাদীস (১৯১৪), দৈনিক নবযুগ (১৯২০), দৈনিক সেবক (১৯২১), ধুমকেতু (১৯২২), সাপ্তাহিক লাঙল (১৯২৫), দৈনিক ছোলতান (১৯২৬), দৈনিক আজাদ (১৯৩৬)।

১৯৪৭ এ ব্রিটিশ বিদায় নিল। ভারত ও পাকিস্তান দু’টি রাষ্ট্র স্বাধীন হলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হল মাওলানা আকরাম খাঁ-এর আজাদ। এটি অবশ্য কোলকাতা হতে স্থানান্তর করে ঢাকায় আনা হলো। তারপর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল দৈনিক সংবাদ, আর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল দৈনিক ইত্তেফাক। এখানে উল্লেখ্য পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের প্রথম সংবাদপত্র হল রংপুরের বার্তাবহ। ১৮৪৭ এর আগষ্টে (১২৫৪ বঙ্গাব্দ) গুরুচরণ রায় এর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক সহ অগণিত সাময়িক পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এসব পত্রিকার মধ্যে যেমন জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা রয়েছে, তেমনই আঞ্চলিক পর্যায়ের পত্রিকাও আছে।

আবার বাংলা ভাষার পাশাপাশি সামান্য কিছু ইংরেজি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকাও প্রকাশিত হতে শুরু করে। ক্রমেই অনলাইন পত্রিকার প্রসার ঘটছে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য মফস্বল শহরের মত সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভাগীয় বন্দর নগরী খুলনাতেও বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুদ্রিত সংবাদপত্র সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। আবার পাঠক সমাজের চাহিদা মেটাতে কালের গতিতে অনলাইন পত্রিকাও প্রকাশিত হতে থাকে। এ বিষয়ে আজ এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না।

এ কথা বলতে খুব আনন্দ লাগছে যে, এখন থেকে এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ১৩ জুলাই বিশ^ব্যাপি ভয়ঙ্কর মহামারি কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে এক নেতিবাচক অবস্থার মধ্যেও আশার আলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘খুলনা গেজেট’। অনেক প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রকাশনার একটি বছর পূর্ণ করতে পারায় খুলনা গেজেটকে অভিনন্দন জানাই। এই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সচেতনতামূলক সংবাদ পরিবেশন করবে ও লেখনি দিবে এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!