ভোজ্যতেলের দাম আবারও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ভোজ্যতেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঈদের পর সরকার ঘোষিত ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাব করা হয়েছে। ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানোর প্রেক্ষাপটে রমজানে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমানো হয়েছিল। ঈদের পর তা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা। এ হিসাবে ঠিক থাকলেও, প্রশ্ন উঠছে—দেশের বাজারে বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম এত বেশি কেন?
প্রশ্নটি উঠছে কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারে সয়াবিন, পাম তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম অত্যধিক বেশি। এমনিতেই দেশের মানুষ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট। বিশেষত দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন যাপন করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়েছে। এর সাথে প্রতিনিয়ত ভোজ্যতেলের মতো অতি জরুরি পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানুষের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ছে।
এ নিয়ে নানা সময়ে নানা কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি। বরং, নিয়ম করেই দেশের বোতলজাত ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এর দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তা ও ভোজ্যতেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আলোচনায় বসছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আবার এ দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মিল মালিকদের সংগঠন ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন মঙ্গলবার এক চিঠিতে জানায়, লিটারে ১০ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৩ টাকা। এর আগে প্রতি লিটারের দাম ছিল ১৬৩ টাকা।
এতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার থেকে ৫ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ৮৪৫ টাকায়। আর প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হবে ১৩২ টাকায়।
রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সয়াবিন তেলে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত সোমবার ভ্যাট ছাড়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ওইদিনই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে মিল মালিকদের সংগঠন। তেলের দাম বাড়াতে বাণিজ্যসচিবকে চিঠি দেয় মিল মালিকদের সংগঠন বনস্পতি।
এবার কিছু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। বাংলাদেশে সয়াবিন, পাম তেলসহ বিভিন্ন ধরনের ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা রয়েছে কম–বেশি ২০ লাখ টনের। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে মেটানো যায় ২ লাখ টনের চাহিদা। বাকি ১৮ লাখ টনই আসে আমদানি থেকে।
বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে সয়াবিন তেলের দাম পাউন্ডপ্রতি দশমিক ৪৫ মার্কিন ডলার। লিটারের হিসাবে গেলে এক লিটার তেলে দুই পাউন্ডের কম লাগে। তাও হিসাবের সুবিধার জন্য ২ পাউন্ডের দামকে ধর্তব্যে নিলেও লিটারপ্রতি দাম দাঁড়ায় ৯০ সেন্ট, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৭ টাকার কিছু বেশি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আজকের বাজারে যে সয়াবিন তেল, তা নিশ্চয় আজকের দামেই আনা হচ্ছে না। না। আন্তর্জাতিক বাজারে সাধারণত বড় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ছাড়া স্পট মার্কেট নয় বরং ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে পণ্য আমদানি করা হয়। সয়াবিনের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে ধরে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দাম কেমন ছিল?
আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের তথ্যদাতা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সমুন্ডির তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে সয়াবিন তেলের টনপ্রতি দাম ছিল ৯৭১ দশমিক ৪৬ মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এ দাম কমে দাঁড়ায় ৯১১ দশমিক ৯০ ডলারে। লিটারের হিসাবে এলে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিল জানুয়ারিতে ১০৬ এবং ফেব্রুয়ারিতে ১০০ টাকার মতো।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বেচাকেনা দুই ধরনের চুক্তিতে হয়। প্রথমটি—স্পট মার্কেট। সাধারণত জরুরি প্রয়োজনেই এই চুক্তি অবলম্বন করা হয়। আর থাকে ফিউচার মার্কেট, যেখানে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তি করা হয়। এই চুক্তি সাধারণত ১–৩ মাসের চুক্তিতে করা হয়। অর্থাৎ, জানুয়ারিতে হওয়া চুক্তির পণ্য হাতে পাওয়া যাবে মার্চ বা এপ্রিলে। বাংলাদেশের আমদানিকারকেরাও এর ব্যতিক্রম নয় বলে ধরে নেওয়া যায়। বলে রাখা ভালো যে, স্পট মার্কেটে পণ্যের দাম সাধারণত ফিউচার মার্কেটের চেয়ে বেশি হয়। ফলে ইনডেক্সমুন্ডি বা বিজনেস ইনসাইডারে সয়াবিনের আজকের যে দর দেখা যাচ্ছে, ফিউচারে তা কিছুটা কম থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
ফলে এখানে জানুয়ারি, বড়জোর ফেব্রুয়ারির দামকে ধর্তব্যে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। সেই হিসাব বিবেচনায় নিলেও দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম ছিল আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অত্যধিক বেশি। এমনকি গত বছরের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম যখন তুলনায় বেশ বেশি ছিল, (টনপ্রতি দাম ১১৩৫ ডলার) তখনকার হিসাব নিলেও লিটারপ্রতি দাম দাঁড়ায় ১২৩ টাকা। অর্থাৎ, সেই উচ্চদামে কেনা সয়াবিন হলেও তার দাম দেশের বাজারে কোনোভাবেই ১৭৩ টাকা লিটার হতে পারে না। এমনকি রমজানের আগের দাম ১৬৩ টাকাও নয়।
আসা যাক পাম তেলের কাছে। দেশের বাজারে থাকা পাম তেলের ৮০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। মাত্র ২০ শতাংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে। মালয়েশিয়ার পাম তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনায় বেশি। বিজনেস ইনসাইডার ও ইনডেক্সমুন্ডির হিসাব নিলে দেখা যায়, এ দাম কোনোভাবেই লিটারপ্রতি ৯২ টাকার বেশি নয়। আর ইন্দোনেশিয়ার পাম তেলের লিটার ৮৭–৮৮ টাকা। বলে রাখা ভালো—এ দুই দরই কিন্তু স্পট মার্কেটের। সেখানে বাংলাদেশে খোলা পাম তেলের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১৩২ টাকা লিটার!
মিল মালিকেরা বলতে পারেন, দেশের মিলগুলো আমদানি করা ভোজ্যতেল তো বোতলজাত করা হয়। প্রশ্ন হলো—বোতলজাত করতে কত খরচ পড়ে? বোতলজাত করার কারণে লিটারে দর ৫০–৭০ টাকা বাড়তে পারে কিনা?
বাংলাদেশের বাজার এক দারুণ ম্যাজিকের জায়গা। এখানে কোনো কিছুর দাম বাড়লে, সহজে কমে না। সে রেওয়াজই নেই। সবকিছুর মতো শনৈ শনৈ উন্নতিই যেন এখানকার একমাত্র ব্যাকরণ। দ্রব্যমূল্যও তাই একবার কোনো কারণে বাড়লে, তা আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। ভোক্তারাও এ দেশে সে অর্থে সোচ্চার নয়। প্রথম কিছুদিন রাগ–ক্ষোভ দেখিয়ে, তারপর ঠিকই বর্ধিত মূল্যের গিলোটিনে নিজের মাথাটি সঁপে দেন। অথচ সম্প্রতি গরুর মাংসের বাজার ভোক্তাদের শক্তির পরিচয়টি দিয়ে গিয়েছিল।
আশার কথা এই যে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সয়াবিন তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। সয়াবিন তেলের পূর্বের দামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ট্যারিফ কমিশন কাজ করছে। সমন্বয় করে যৌক্তিক দামে মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার।
কিন্তু ভোক্তাদের মনে রাখা দরকার, সরকার এর আগেও বহুবার মিল মালিকদের সাথে বসেছে, চালকল মালিকদের সাথে বসেছে, ব্যবসায়ীদের সাথে বসেছে। কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি, যাকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি বলা যায়। এবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বসবে বলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সয়াবিনের দর কমবে কিনা, কমলে, কতটা কমবে, তা বলা যাচ্ছে না। যদি লিটারপ্রতি ভোজ্যতেলের দর কমেও, তা কি বিশ্ববাজরের সাথে সমন্বয় করে যৌক্তিক পর্যায়ে আসবে? সরকারকে সে আলোচনায় শক্তি জোগাতে ভোক্তারা জোর গলায় শুধু কথা নয়, নিজেদের ভোগ কমিয়ে কোম্পানিগুলোকে কোনো বার্তা কি দেবে? নাকি বরাবরের মতোই কয়েক দিন কথা বলে চুপ করে যাবে? শেষের এই দুই প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভর করছে প্রথম প্রশ্নটির উত্তর।
সূত্র : ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।
খুলনা গেজেট/এনএম