খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  নরসিংদীতে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় যুবককে গুলি করে হত্যা
  ঘন কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ১০ যানবাহনের সংঘর্ষ, নিহত ১, আহত ১৫
  ব্রাজিলে দুর্ঘটনায় বাসে আগুন, পুড়ে নিহত ৩৮

বিশ্বনবী (সা.) সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত

হাফিজ মাছুম আহমদ

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সমগ্র সৃষ্টি তথা বিশ্বমানবের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির পয়গাম নিয়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার প্রভাতের সময় মহাবিশ্বে আগমন করলেন প্রিয় নবী, শেষ নবী, রহমাতুল্লিল আলামিন, শান্তির অগ্রদূত, মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

সৃষ্টির শুরু থেকেই উভয় জগতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব রহমত ও দয়া এ নবীর অসিলায় প্রবাহিত করছেন। মহানবী (সা.)-এর আগমনের দিন পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে নবী আমি আপনাকে সারাবিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (২১-সূরা আম্বিয়া)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন বিশ্ব তথা মানব জাতির জন্য রহমত হিসেবে। হজরত আদম (আ.)- এর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে প্রথম নবীর আগমন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)’র আগমনের মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী-রসুলের আগমন পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েছে। মহানবী মুহাম্মদ (সা.)’র পর পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবেন না।

তিনি হলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মনোনীত নবী। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে তারা তার উম্মতের মধ্যেই গণ্য হবে। পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবে না। মুহাম্মদ (সা.)’র আগে যে নবী-রসুল (আ.) এসেছেন তাদের বিশেষ সম্প্রদায়ের নবী রসুল হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আখেরি নবীর আগমন ঘটেছে সমগ্র মানব জাতির জন্য।

মহানবী (সা.) দুনিয়ায় এসেছিলেন মিথ্যা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে। যারা সত্যের পথের অনুসারী তাদের আখিরাতের জীবনে কীভাবে পুরস্কৃত করা হবে তার বার্তাবাহক হিসেবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি, অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (৩৪-সূরা সাবা : ২৮)

রাসুল (সা.)’র আগমনের কথা পবিত্র কোরআনের পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোতেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পাঠানো রসুল, সত্যতা বিধানকারী সেই তাওরাতের, যা আমার আগে এসেছে, আর সুসংবাদদাতা এমন একজন রসুলের যে আমার পরে আসবে, যার নাম হবে আহমদ।’ (৬১-সূরা আস-সফ : ৬)

সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না এবং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। কারণ তাঁর পর দুনিয়ায় আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না।

এই প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “অন্য নবীরা তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।”

মহানবী (সা.) পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই।

নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁরই দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রদীপ্ত চেরাগরূপে।” (সূরা আহজাব, আয়াত ৪৫-৪৬)।

সমগ্র সৃষ্টির প্রতি সষ্টার এই যে মহান করুণা তাঁর জন্য মানবকুল তাঁর কাছে ঋণী। পরবর্তী পর্যায়ে যার মাধ্যমে এই রহমত ও নিয়ামতের অধিকারী হল, তাঁরই নিকট ঋণী। সেই মাধ্যম হলো মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.), যিনি মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিলেন, পবিত্র করলেন।

সমগ্র মানবকুল সৃষ্টি জগত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁরই কাছে ঋণী। কে তাকে স্বীকার করল, কে করুণা সে কথা এখানে গৌণ। তিনি সকল মানুষকে, সকল নবীকে, সকল আসমানী কিতাবকে স্বীকার করেছেন। কাউকে অস্বীকার করার মতো মানসিক দুর্বলতা তাঁর মধ্যে মোটেই ছিলনা। তাই তিনি বিশ্বনবী, শ্রেষ্ঠ নবী (সা.)। সকল মানবিক আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হলেন তিনি।

রাসুল (সা.)’র মন ছিল আকাশের মতো উদার, সত্যে প্রতি অবিচল। জীবনে কোনো দিন কোন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। কোন মিথ্যা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, দানে-ধ্যানে জ্ঞানে, বিচারে-সহানুভবতায় তিনিই ছিলেন তার দৃষ্টান্ত। তার পরিকল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ, তার সংকল্পও ছিল তেমনি সুন্দর। যে কোন ন্যায়, সত্য পরিকল্পনাকে কার্যকরী করে মহান আল্লাহর হুকুম কায়েম করাই ছিল রাসুল (সা.)’র একমাত্র লক্ষ্য।

বিশ্বের সব মানুষের কাছে দ্বীনে মুহাম্মদীর প্রকৃত দিকনির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। বর্তমান মুসলিম উম্মাহর এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ ও ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হচ্ছে প্রিয় নবীকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা।

যেহেতু রাসুলের প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ তাঁর প্রতি ভালোবাসার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, সেহেতু রাসুলপ্রেমই আল্লাহপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত! যার ভেতর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা নেই, সে মুমিন হতে পারে না। শুধু বাহ্যিক সুন্নাত পালন রাসুলপ্রেম নয়। বাহ্যিক সুন্নাহর সঙ্গে আন্তরিক ও আত্মিক সম্পর্ক থাকতে হবে এবং এ আত্মিক সম্পর্কের ফলে প্রেমিকের দৃষ্টিতে শুধু প্রেমাস্পদই বিরাজ করে।

আল্লাহপাক বান্দার কল্যাণার্থে অসংখ্য ‘নিয়ামত ও রহমত’ প্রদান করেছেন। তার মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ‘নিয়ামত ও রহমত’ হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীজির ইহধামে শুভাগমন! আর এই নিয়ামত ও রহমত পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশেই আছে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির উপায়।

যেহেতু প্রিয় নবীর শুভাগমন জগদ্বাসীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে বিভ্রান্ত মানবজাতি আলোর পথের সন্ধান পেয়েছেন, গোমরাহীর অতলগহ্বরে নিমজ্জিত দিকভ্রম বনি আদম তাঁরই অসিলায় আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত। নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত, মানব গোষ্ঠীকে তিনি চিরকল্যাণকর আদর্শের পথে আহ্বান করেছেন এবং সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তাঁর আবির্ভাব উম্মতের জন্য কত বড় রহমত ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করে সেই মহান রবের নিয়ামত প্রিয় নবীকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ ও পাথেয়। তাই মহানবী (সা:) এর জীবনের সুমহান আদর্শের ওপর গভীর আলোকপাত করে মানব জীবনে তা বাস্তাবায়ন করার প্রত্যয়দীপ্ত শপথ নিতে হবে আজ। তাহলে তার জীবন দর্শনের সঠিক মূল্যায়ন হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) গোত্রীয় শাসনের স্বৈরাচারে দগ্ধ, মুষ্টিমেয় বিত্তশালীর শোষণে নিঃস্ব, সামাজিক দূরাচারে অতিষ্ঠ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেয়েছেন। তিনি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাওহিদের বাণী প্রচারের দায়ে স্বজাতির নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অতঃপর ঐতিহাসিক মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইহুদি, পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের নিয়ে মদিনাতে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতি ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসুলের আদর্শিক জাগরণ সমগ্র আরবকে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সুশাসন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আজ যখন দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যখন অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার অভাব জনজীবনে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন মানুষ একে অপরের দ্বারা নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে- তখন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর শিক্ষা হোক ও শপথ হোক রাসুল (সা.)’র ভালোবাসার দাবিতে সংঘাত নয়, চাই রাসুল (সা.)’র আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ।

আমরা রাসূল (সা.)’র সাথে যত বেশি মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, যত বেশি দরুদ ও সালাম পাঠাব ততই বাতিল, তাগুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। ঈদে মিলাদুন্নবী সবার জন্য হোক মুবারক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও কলামিস্ট।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!