খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ মাঘ, ১৪৩১ | ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
গবেষণার তথ্য

বায়ুদূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭ বছর কমছে

গেজেট ডেস্ক

বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। দূষিত বায়ুতে থাকার কারণে বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের মধ্যেও একেক এলাকার বায়ুর অবস্থা একেক রকম। এর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে গাজীপুর। ঢাকার সবচেয়ে কাছের ওই শিল্প এলাকার মানুষদের আয়ু বায়ুদূষণের কারণে আট বছর তিন মাস কমে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা বায়ুদূষণ–বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের কোন দেশের অধিবাসীদের গড় আয়ু কী পরিমাণে কমছে, সেই হিসাব ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড়পড়তায় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে বলে বেরিয়ে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ুদূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। আর এতে গড় আয়ু দুই বছর আট মাস কমেছে। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।

গত এক যুগে বিশ্বে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশটি দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দূষণ রোধে তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করেছে। দূষণকারী শিল্পকারখানার সংখ্যা কমিয়েছে। রাস্তায় পানি ছিটানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে দেশটির বায়ুর মান ৪২ শতাংশে বেশি উন্নতি হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি বায়ুর মানবিষয়ক তথ্য শুধু ঢাকা শহরের জন্য প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর দিয়ে থাকে। আর দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোর তথ্য আসে এক দিন পর। ফলে কোনো এলাকার বায়ুর মান তাৎক্ষণিকভাবে নাগরিকেরা জানতে পারে না। ফলে সেখানে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া যাবে বা দূষিত বায়ু থেকে রক্ষা পেতে সেখানে আদৌ যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম। বিশ্বের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নত রাষ্ট্র অ্যাপসের মাধ্যমে বায়ুর মানের তথ্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে তা এখনো শুরুই হয়নি।

অথচ বাংলাদেশে বড় শহরগুলোর বায়ুর মানের প্রতি ঘণ্টার তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে থাকে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালসহ বিভিন্ন সংস্থা এসব তথ্য নিয়মিত বা সরাসরি দিয়ে থাকে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের বায়ুর মানবিষয়ক তথ্য প্রদান যথেষ্ট সময়োপযোগী ও নির্ভরযোগ্য নয়।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা আগামী এক মাসের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গার বায়ুমানের তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে দিতে পারব। সেই সক্ষমতার দিকে আমরা যাচ্ছি। আর এক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতো সরাসরি বায়ুর মানের তথ্য অ্যাপসের মাধ্যমে তা তুলে ধরব।’

সবচেয়ে নির্মল বায়ুর সিলেটেও ১০ গুণ দূষণ
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রা, প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে কম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ থাকতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব মানমাত্রা হিসাবে পিএম-২.৫ ঘনমিটারে ১৫ নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মল বায়ুর জেলা সিলেটেও এর চেয়ে বেশি মাত্রায় বায়দূষণ থাকছে। ওই জেলাতেও ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশের নিজস্ব মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেদনটিতে বিশ্বে অন্য যেসব কারণে সামগ্রিকভাবে গড় আয়ু কমে, তার সঙ্গে বায়ুদূষণের তুলনা টানা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু কমছে হৃদ্‌রোগ ও রক্তপ্রবাহের সমস্যার কারণে। এতে বাংলাদেশের একেক অধিবাসীর গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। এর পরেই রয়েছে বায়ুদূষণ। ধূমপানের কারণে কমছে দুই বছর এক মাস, শিশু ও মাতৃত্বকালীন অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে কমছে এক বছর চার মাস আয়ু।

বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর বায়ুর মান গ্রামের তুলনায় বেশ খারাপ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে এখানকার ৭ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ বসবাস করে। এসব শহরের অধিবাসীদের গড় আয়ু সাত বছর ছয় মাস কমে যাচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে বায়ুর মান ঠিক করা গেলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষদের গড় আয়ু বাড়তে পারে। ঢাকায় এভাবে গড় আয়ু আট বছর এক মাস বাড়ানো সম্ভব। আর চট্টগ্রামে তা বাড়তে পারে ৬ বছর ৯ মাস। আর সারা দেশের গড় আয়ু বাড়তে পারে পাঁচ বছর আট মাস।

তথ্যের সমস্যা বড় বাধা
প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বায়ুর মান বিষয়ে নির্ভরযোগ্য ও সময়মতো তথ্য সরবরাহের ওপরে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব তথ্য যাতে দূষিত বায়ু থেকে রক্ষা পেতে নাগরিকেরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তা–ও নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। এ কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারলে বাংলাদেশে বায়ুর মানের উন্নতি হতে পারে এবং গড় আয়ুও কমতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এ–সংক্রান্ত তথ্য উন্মুক্ত কি না, তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বায়ুর মানবিষয়ক তথ্য পুরোপুরি উন্মুক্ত নয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ–সংক্রান্ত তথ্য পুরোপুরি উন্মুক্ত এবং সময়মতো হওয়া উচিত, যাতে তা সাধারণ নাগরিকেরা ব্যবহার করতে পারে।

বায়ুদূষণ বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। সামগ্রিকভাবে দূষিত বায়ু মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। তবে ওই দূষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ছয়টি দেশে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।

সামগ্রিকভাবে ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন মেনে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ করলে বিশ্বের অধিবাসীদের গড় আয়ু দুই বছর তিন মাস বাড়ানো সম্ভব। আর বছরে বিশ্বের এক কোটি ৭৮ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বিশ্বে নানা কারণে মানুষের মৃত্যুর মধ্যে বায়ুদূষণ এখন শীর্ষে চলে এসেছে। এর মধ্যে ধূমপানে মৃত্যুর চেয়ে তিন গুণ, সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর তুলনায় ৫ গুণ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যাচ্ছে। বায়ুর মান অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষদের আয়ু এক থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কমে যাচ্ছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মিখাইন গ্রিনস্টোন এ ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিক সংবাদকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে বায়ুদূষণ–সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিদিন প্রকাশ করা উচিত। কারণ, অনেক দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো বিশ্বের মোট দূষিত বায়ুর ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ নির্গত করে। এশিয়ার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং আফ্রিকার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ রাষ্ট্র তার জনগণের জন্য বায়ুর মানবিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্য সঠিক সময়ে সরবরাহ করে থাকে। একই সঙ্গে এশিয়ার ৩৫ দশমিক ৬ এবং আফ্রিকার ৪ দশমিক ৯ শতাংশ দেশে নিজেদের বায়ুর মানমাত্রা আছে। একই সঙ্গে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে কোনো বৈশ্বিক তহবিল নেই। কিন্তু এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা বিষয়ে বৈশ্বিক তহবিল রয়েছে।

এসব তহবিল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরে ৪০০ কোটি ডলার সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বছরে মাত্র তিন লাখ ডলার পেয়েছে। ওই অর্থের জোগান আসছে মূলত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে। ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিবারের বার্ষিক ব্যয়ের সমান। আর এশিয়ার দেশগুলোতে যাচ্ছে ১৪ লাখ ডলার। আর ক্লিন এয়ার ফান্ড থেকে চীন, ভারত, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা মিলে মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার নিচ্ছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ার কোয়ালিটি লাইভ ইনডেক্স কর্মসূচির পরিচালক ক্রিস্টিনা হ্যাসেনকর্ফ বলেন, ‘বাতাসকে নির্মল ও দূষণমুক্ত করতে হলে নাগরিক সমাজ ও সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য আমাদের পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।’

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সফল
চীনের উদাহরণ টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটি বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ ক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। তারা ২০১৩ সালের তুলনায় ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ বায়ুদূষণ কমিয়েছে। এতে তাদের নাগরিকদের গড় আয়ু দুই বছর দুই মাস বেড়েছে। তবে এখনো চীনে বায়ুর মান ডব্লিউএইচওর বায়ুমানের তুলনায় ছয় গুণ বেশি। একই সঙ্গে তাদের গড় আয়ু আড়াই বছর কমে যাচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ বাতাস মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বা দূষিত।

আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে কঙ্গো, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং দক্ষিণ আমেরিকার গুয়াতেমালা, বলিভিয়া ও পেরুর বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ। তবে যুক্তরাষ্ট্র নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুর মানের উন্নতি করেছে। দেশটি ১৯৭০ সালের তুলনায় বায়ুর মান ৬৫ শতাংশ উন্নতি করেছে। তবে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা এক বছর চার মাস বেশি বাঁচে। এর কারণ দেশটি নির্মল বায়ু আইন করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে।

বায়ুর মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে ইউরোপের দেশগুলো। এখানকার অধিবাসীরা ১৯৯৮ সালের তুলনায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ ভালো বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। এখানকার বেশির ভাগ দেশ এয়ার কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক ডিরেক্টিভ তৈরি করেছে। ওই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো সেখানকার ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বায়ুর মধ্যে বাস করে। তবে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুর মান ওই মানমাত্রায় পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। সূত্র : প্রথম আলো।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!