টাকার অভাবে এক বছর থেকে বন্ধ রয়েছে বাগেরহাটের নারী উদ্যোক্তা মেরী বেগমের টিস্যু ব্যাগ কারখানা। কাজ না থাকায় বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন কারখানার শ্রমিকেরা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নষ্ট হতে চলেছে কারখানার মেশিন, কাঁচামালসহ কোটি টাকার সরঞ্জাম। এর সাথে রয়েছে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের কিস্তি আদায়ের চাপ।
মা-ছেলের ঘাম-ঝরিয়ে আয় করা টাকায় গড়ে তোলা কারখানাটি গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার বৈটপুর গ্রামের মেরী বেগমের। মাত্র ২০ লক্ষ টাকা মূলধন হলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ৬৫ বছর বয়সী নারী উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, বিয়ের পরে অভাবের তাড়নায় স্বামী-সহ চট্টগ্রামে চলে যাই। গার্মেন্টসএ কাজ করে স্বামী-সন্তান নিয়ে মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল। সব সময় আসা ছিল গ্রামে যাব, সেখানে কিছু একটা করব। কিন্তু সন্তানাদি সহ শহরে থেকে-খেয়ে টাকা বাঁচানো খুবই দুরূহ ব্যাপার। এরপরও সংসারের খরচ সীমিত করে ২৪ বছরে জমানো লাখ পাঁচেক টাকা নিয়ে গ্রামে আসি। ২০০৮ সালের প্রথম দিকে স্বামী ফকির নুরুজ্জামান ও গার্মেন্টস মেকানিক ছেলে মোঃ মিলনকে সাথে নিয়ে টিস্যু ব্যাগের ব্যবসা শুরু করি। বৈটপুর বাজারস্থ একটি ঘরভাড়া নিয়ে স্বল্প পরিসরের ব্যবসায় মোটামুটি লাভ হতে থাকে। লাভ ও কর্মচারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে প্রতিষ্ঠানে।
মূলধনের সংকট মেটাতে ২০১৭ সালে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করি। ভাল ব্যবসা হওয়ায় দুই বছরেই তাদের ঋণ শোধ করে দেই। ২০১৯ সালে কারখানা বড় করার জন্য বৈটপুর বাজার থেকে পার্শ্ববর্তী বটতলা বাজারে জমি লিজ নেই। সেখানে ১০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে কারখানার ভবন তৈরি করি। বৈটপুর বাজারের কারখানা থেকে পুরোনো মেশিনপত্র বিক্রি করে দেই। ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণের আশ্বাসে ৪২ লক্ষ টাকায় মেশিন ক্রয়ের চুক্তি করি। কিন্তু ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেড মেশিন ক্রয়ের জন্য আমাকে মাত্র ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। ৩ মাস পরে আবারও কাঁচামালের জন্য ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার অঙ্গিকার করে। কিন্তু মেশিন ও আনুসঙ্গিক মালামালের জন্য আমার ৬০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়ে যায়। যার ফলে আমাদের নিজস্ব মূলধনের পাশাপাশি প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা ধার-দেনা করে সংগ্রহ করি। এরপরে কাঁচামালের জন্য অবশিষ্ট কোন টাকা না থাকায় ফ্যাক্টরী পুরোদমে চালু করতে পারিনি।
মেরি বেগম আরও বলেন, ফ্যাক্টরী চালু করতে না পারলেও ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে প্রায় ১০ মাস ১০ কিস্তিতে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সকে ৯ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করেছি। কারণ তারা আমাকে বলেছিল ঋণের কিস্তি দিলে ৬ মাস পরে কাঁচামালের জন্য আরও ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেবে। কিন্তু ১০ মাসেও তারা আর ঋণ দেয়নি। এদিকে মূলধনের অভাবে আমার ফ্যাক্টরী বন্ধ রয়েছে। ফ্যাক্টরীর মূল্যবান মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। আমার পরিবারও এক ধরণের মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যদি মাত্র ২০ লক্ষ টাকা ঋণ পাই, তাহলে আবারও ব্যবসা করে সবাইকে নিয়ে ভাল থাকতে পারব। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
মা-মেরী টিস্যু ব্যাগ কারখানার ব্যবস্থাপক হারুণ শেখ বলেন, ফ্যাক্টরী চালু থাকা অবস্থায় বাগেরহাটসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় আমরা ব্যাগ সাপ্লাই দিতাম। ২০২০ সালের মার্চ থেকে আমাদের কারখানা বন্ধ। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কয়েক মাস ২২জন শ্রমিককে বেতন দিয়েছি। কিন্তু বর্তমানে এমন অবস্থা আমাদের যে মালিকের ঘরেও খাবার নেই। এই অবস্থায় মালিকসহ আমাদের ২০-২৫টি পরিবারের না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে। অন্তত শ্রমিক পরিবারগুলোর কথা চিন্তা করে হলেও এই ফ্যাক্টরীটিকে আবারও চালুর দাবি জানান তিনি।
মেরি বেগমের ছেলে মোঃ মিলন বলেন, সবকিছু ছেড়ে মায়ের সাথে ব্যাগের ব্যবসা করতাম। ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের প্রতারণায় আমার ফ্যাক্টরী আজ বন্ধ। শ্রমিকরা না খেয়ে মরতেছে। আমার রক্ত পানি করা টাকায় কেনা মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইউনাইটেড ফাইন্যান্স এর আগে আমাদের দুইবার ঋণ দিয়েছে, আমরা তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছি। এবারও তারা আশ্বাস না দিলে আমরা এত বড় বেশি দামের মেশিন কিনতাম না। তাদের আশ্বাসে এই মেশিন কিনেছি। এই মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা এত বেশি যে দুই সপ্তাহ মেশিন চালাতে অন্তত ২০ লক্ষাধিক টাকার কাঁচামাল প্রয়োজন।
এই অবস্থায় অন্তত ২০ লক্ষ টাকা পেলে আমরা আবারও শুরু করতে পারতাম। আমার শ্রমিকরাও খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারত। বৃদ্ধ মা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কামনা করেন এই ব্যবসায়ী।
মোঃ মিলন আরও বলেন, ফ্যাক্টরী চালুর জন্য স্থানীয় অনেক ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করেছি। সবাই বলে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের সাথে আগে লেনদেনের সমাধান করুন, তারপর ঋণ পাবেন। অন্যদিকে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সও আমাকে আর টাকা দিচ্ছে না। বরং তাদের পাওনা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। দু-এক মাসের মধ্যে ফ্যাক্টরী চালু করতে না পারলে মাকে নিয়ে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিলন।
ঋণের বিষয়ে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের হেব অব কর্পোরেট ও স্ট্রাকচার্ড ফাইন্যানস এমডি মাহবুবুর রহমান খান বলেন, মেরী বেগমের ঋণের বিষয়টি আমি অবগত রয়েছি। তবে এ বিষয়ে আমি অফিসিয়ালি কোন কথা বলতে পারব না।
খুলনা গেজেট/এম এইচ/ এস আই