বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ, পূর্ণিমার প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারের পানিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় মোংলা বন্দরে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। গেল পাঁচ দিন ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উচু জোয়ারে দু’বার করে ডুবছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা। সুন্দরবনের পাশাপাশি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অন্তত দুই সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্ধি রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী জেলা ৭৫০টি পরিবার পানিবন্ধি রয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাফিজ আল আসাদ।
খোজ নিয়ে জানাযায়, জেলার মোংলা পৌরসভা, মোরেলগঞ্জ পৌরসভা ও বাগেরহাট পৌরসভার কিছু অংশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মোরেলগঞ্জের বহরবুনিয়া, খাউলিয়া, পুটিখালী, তেলিগাতি, হোগড়লাপাশা, কচুয়ার রাড়িপাড়া, বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা, ডেমা, কাড়াপাড়া, মোংলার সুন্দরবন, জয়মনির ঘোল, চিলা, রামপালের হুড়কা, বাসতলী, শরণখোলার সাউথাখালী ও রায়েন্দা ইউনিয়নের বেশকিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অন্তত দুই সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্ধি রয়েছে। বেশকিছু মাছের ঘেরও ডুবে যাওয়ার খবর রয়েছে।
কাড়াপাড়া ইউনিয়নের মাঝিডাঙ্গা এলাকার আতাহার হোসেন বলেন, জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে বাড়ি-ঘর সব ডুবে গেছে। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি আমরা।
বহরবুনিয়া এলাকার সগির গাজী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ইটের রাস্তা তলিয়ে পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতে রান্না-বান্নাও বন্ধ। পানিতে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছি আমরা।
এদিকে বন বিভাগ সূত্রে জানাযায়, সুন্দরবনের নদ-নদীগুলোতে জোয়ারের সময় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে। পানিতে সুন্দরবনের করমজল, জামতলা, হিরনপয়েন্ট, দুবলারচর, আলীবান্দা, আন্ধারমানিকসহ অধিকাংশ এলাকা দিনে দুইবার করে ডুবছে।
অন্যদিকে জোয়ারে সাগর তীরের সুন্দরবনের দুবলা এলাকায় চার থেকে পাঁচ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা জেলে পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, স্বাভাবিকের তুলনায় সাগরে জোয়ারের পানি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনের ভেতরে জোয়ারে কোথাও ৩ ফুট কোথাও এর কম-বেশি তলিয়ে গেছে। ভাটা হলে আবার পানি নেমে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষয়ক্ষতি নজরে আসেনি।
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল পর্যটন ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজাদ কবির বলেন, গেল চার দিন ধরে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে করমজল। এই এলাকা বনের অন্য অনেক এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু। তার পরও করমজলের রাস্তার ওপরে দেড় ফুট পানি উঠেছে শুক্রবার। বনের অভ্যন্তরে ৩-৪ ফুট উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত বনের কোথাও কোনো প্রাণী ভেসে যাওয়া বা ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। করমজলে কুমির, কচ্ছপ, হরিণ ও বানরসহ অন্যান্য প্রাণী নিরাপদে রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, জোয়ারের কারণে বনের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেলেও তেমন সুন্দরবনের জীবজন্তুর তেমন কোন ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। প্রকৃতিগতভাবেই সুন্দরবনের বড় এলাকা জোয়ারে কিছু প্লাবিত হয়। এখানকার বন্যপ্রাণিগুলোর এই প্রকৃতির সাথে অভ্যস্ত। অতি উঁচু জোয়ারে বনের মধ্যে পানি বাড়ায় বন্যপ্রাণিদের কিছু সমস্যা হলেও বড় ধরণের ক্ষতি হবেনা বলেই ধারণা তার।
তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখে বনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন জায়গায় উঁচু টিলা তৈরি করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যাতে বনে পানি বাড়লে বন্যপ্রাণীগুলো ওই সময়ে উঁচু টিলায় আশ্রয় নিতে পারে। পুরো সুন্দরবনে এধরণের ১২টি টিলা তৈরি করা হবে চলতি অর্থ বছরে।
মোংলা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা হারুণ-অর-রশীদ বলেন, গেল ২৪ ঘন্টায় ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী দুই-তিনদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, সাগরের নিম্নচাপ-লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও পূর্ণিমার গোনের কারণের পশুর, বলেশ্বর, পানগুছি, ভৈরবসহ জেলার প্রায় সকল নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়েছে। পশুর নদীর পানি বিপদ সীমার ১৫ সে.মি এবং দড়াটানা ও ভৈরবের পানি বিপদ সীমার ১০ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জোয়ারের সময় দুই থেকে তিন ফুটের অধিক উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হলেও কোথাও বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে নেই। বৃষ্টি কমলে এবং পূর্ণিমার গোন শেষ হলে আগামী তিন চারদিনের মাঝেই পানির চাপ কমে আসবে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাফিজ আল আসাদ বলেন, জেলায় ৭৫০টি পরিবার পানিবন্ধি রয়েছে। আমরা তালিকা করে দূর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি নাগরিকদের খোজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/ বিএম শহিদুল