বিশ্বজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে আর্টিকেল নাইনটিন। মানবাধিকারের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিবছর আর্টিকেল নাইনটিন ‘বৈশ্বিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিবেদন’ প্রস্তুত করে।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করলো আর্টিকেল নাইনটিন, দক্ষিণ এশিয়া।মঙ্গলবার (২১মে) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোর হাইটসে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম জানান, বৈশ্বিক মতপ্রকাশ প্রতিবেদন ২০২৪ অনুসারে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মতপ্রকাশ স্কোর বা জিআরএক্স স্কোর মাত্র ১২। যেটি ২০২২ সালের অনুরূপ। স্কোর একই থাকলেও অবস্থানগত (র্যাংকিং) দিক থেকে দুই ধাপ এগিয়েছে। অবস্থান ১২৮তম। যেটি ২০২২ সালে ছিল ১৩০।
তিনি জানান, ৫ বছরের সময়কাল (২০১৮-২৩) বিবেচনায় নিলেও স্কোরের দিক থেকে একই জায়গায় আটকে আছে বাংলাদেশ। কেননা ২০১৮ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১২ বা সংকটজনক ক্যাটাগরিতে, অবস্থান ১৩৪। এই ৫ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ১১ ও ১২ এর মধ্যে ছিল।
তিনি আরও জানান, বিগত দশ বছর বা ২০১৩-২০২৩ সাল এই সময়কাল বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের মতপ্রকাশ স্কোর কমেছে ৮ পয়েন্ট। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিআরএক্স স্কোর ছিল ২০ যা মতপ্রকাশের শ্রেণিগত দিক থেকে অতি বাধাগ্রস্ত দেশ। ২০১৪ সালে স্কোর ৪ পয়েন্ট কমে ১৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মতপ্রকাশের সংকটজনক শ্রেণিতে ঢুকে পড়ে, যা থেকে বাংলাদেশ এখনো উত্তরণ ঘটাতে পারেনি।
একইভাবে ২০০০ সাল থেকে মতপ্রকাশের স্কোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে ৩২ পয়েন্ট। ২০০০ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৪, যেটি মতপ্রকাশের শ্রেণিগত দিক থেকে ‘বাধাগ্রস্ত’ হিসেবে বিবেচিত। ‘বাধাগ্রস্ত’ থেকে ‘অতি বাধাগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবনমন হয় ২০০৬ সালে। ২০০৫ সালের তুলনায় ৪ পয়েন্ট কমে স্কোর নেমে আসে ৩৯-এ। পরবর্তী বছর ২০০৭ সালে আরও ১০ পয়েন্ট কমে স্কোর নেমে আসে ২৯-এ। পরের দুই বছর (২০০৮ ও ২০০৯ সালে) স্কোর ৫ পয়েন্ট বেড়ে ৩৪-এ উন্নীত হলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তী বছরগুলোতে। বরং বছর বছর স্কোর কমেছে এবং মতপ্রকাশের সংকটজনক শ্রেণিতে নেমে আসে ২০১৪ সালে।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান উপস্থিত ছিলেন।
এসময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের জন্য ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সমালোচনা গ্রহণ করার সংস্কৃতি দেশে গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার রাজনীতির হাতে মতপ্রকাশ জিম্মি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারি ও সভা-সমাবেশ করার অধিকারের দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। গণমাধ্যমে নাগরিক সমাজের জন্য ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আইন করা হচ্ছে নিবর্তনমূলক, ব্যক্তির পরিচয় ভেদে ভালো আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্কোর থেকে ভয়াবহতা বোঝা যায় না। সরকারের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা। সরকার সত্যিকারের গণতান্ত্রিক হলে বিরুদ্ধ মত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও চর্চা যতক্ষণ একটা ন্যূনতম পর্যায়ে না গেলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত পর্যায় থেকে উত্তরণ হবে না।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, সরকার জনগণকে ভয় পেলে সেটি বিপজ্জনক। সরকার জনগণকে ভয় পেলে তারা নানাভাবে আইন দিয়ে সেটা মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। সাইবার নিরাপত্তা আইন হয়েছে। সেটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে কিছুটা নমনীয়। কিন্তু ভয়ের সংস্কৃতি রয়েই গেছে। যত দিন এই ভয়ের সংস্কৃতি থাকবে, তত দিন মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অবনতি ঘটতে থাকবে।
খুলনা গেজেট/এএজে