খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ২৬৯/৯, পিছিয়ে ১৮১ রানে

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনের এক ভ্যানগার্ড

কাজী মোতাহার রহমান

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ২৬ মাস বাকী। পাঁচ বছরের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালে। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে দর্শনে বিশ্বাসীরা নানা প্রশ্ন তোলেন।

তাদের শরীকরা গেল সংসদ নির্বাচন মেনে নিতে পারেনি। তবে এ নিয়ে আন্দোলন বেগবান হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এ দাবিতে দলের মহাসচিব প্রতিদিনই সোচ্চার। কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন শীর্ষ নেতারা। মাস দুয়েক ধরে বিএনপির দাবি মিডিয়ায় শিরোনাম হচ্ছে। দলের হাইকমান্ড এই সাথে সংগঠনের সকল স্তরে আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। হাইকমান্ড বলেছেন, দলকে শক্তিশালী করতে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন করতে হবে। এমন সময়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শিবিরের এক সোচ্চার কন্ঠের অনুপস্থিত অনুভব হচ্ছে। এক বছর আগে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন।

বিএনপি প্রধানের উপদেষ্টা হিসেবে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করা এই ব্যক্তিত্ব এম নুরুল ইসলাম। সতীর্থরা তাকে দাদু ভাই বলে সম্বোধন করতেন।

নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৪৮ সালে তিনি এ ছাত্র সংগঠনের খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ব্রিটিশ জামানায় ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে খুলনা আসন থেকে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর প্রার্থী হন। এ সময়ে এম নূরুল ইসলাম মুসলিম লীগের সমর্থক হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭৯ সালে খুলনা সদর আসনে মুসলিম লীগের মনোনয়নে খান এ সবুর এর বিরুদ্ধে বিএনপি’র মনোনয়নে এম নুরুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম সোচ্চার হন। মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগের গণবিরোধী চরিত্রের কারণে নুরুল ইসলাম তাদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। যোগ দেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দলে । এ দলের খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার। তিনি ডুমুরিয়ার সন্তান। পাকিস্তান আমলের খুলনার নামী দামী উকিল। এক সময় খুলনা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন। ১৬ সদস্যের খুলনা জেলা কমিটির একজন হলেন এম নুরুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর পরিসরে তার রাজনীতির সূচনা। পরবর্তী ধাপে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। গণতন্ত্রী দলের সংগঠক হিসেবে ৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে খুলনাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টের শরীক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সেনা প্রধান জেঃ আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন।

শুরু হয় ভোটাধিকারের আন্দোলন। ১৯৬২ সালে খুলনা পৌরসভার জাহানাবাদ ইউনিয়নে নির্বাচনে নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আত্মপ্রকাশ করলে তিনি গণতন্ত্রী দল ছেড়ে ন্যাপে যোগদান করেন। এখানে দায়িত্বশীল হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। জে. আইয়ুব খানের শাসনামলের পুরো সময়টাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জে. আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দল-কপের প্রার্থী ছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। কপের পক্ষে নুরুল ইসলাম প্রচারে অংশ নেন। সেদিনও তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। জে. আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তোলেন কপ। জে. আইয়ুব খান পুরো পাকিস্তানের সমালোচিত হন। ১৯৬৯ সালে সেনাপ্রধান জে. ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করলে তখনও সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। সামনে আসে সত্তরের নির্বাচন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। সামনে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাক বাহিনীর অত্যাচার শুরু হলে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যেয়ে যুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে খুলনা শহর ন্যাপের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা সদর আসন থেকে শাসক দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিরোধী দল ন্যাপের প্রার্থী ছিলেন গাজী শহীদুল্লাহ। সেদিন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ন্যাপ জোরালো ভূমিকা রাখে।

সেনাপ্রধান জে. জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালে গড়ে ওঠে জাগদল। এম নুরুল ইসলাম মার্কসবাদ ছেড়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি এক পর্যায়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ধারক বাহক হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেন। দায়িত্ব পান বিএনপি’র শহর শাখার সভাপতির। তিনিই শহর শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র মনোনয়নে তিনি খুলনা সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হন। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী খান এ সবুর এর কাছে পরাজিত হন। ১৯৯১ সালে খুলনা ১ আসনের প্রার্থী ছিলেন। ২০০১ সালে খুলনা ৪ আসনে বিজয়ী হন। কিন্তু দীর্ঘদিনের সংগ্রামের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান জে. এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন, সামরিক শাসন জারি হয়।

শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাত দলীয় জোট। খুলনার শীর্ষ নেতা হিসেবে দীর্ঘ নয় বছর কাল তাকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন। একানব্বই সালে নির্বাচনে তার দল ক্ষমতা দখল করে। ২০০১ সালের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি সাত দশক সংগ্রাম করেছেন।বয়সের ভারে বার্ধক্যে যখন শয্যাশায়ী বিছানায় শুয়ে দেখতেন সতীর্থরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে করছে । তার মন চাইতো এই মিছিলের নেতৃত্ব দিতে কিন্তু বয়সের ভারে সে বাসনা পূরণ হত না।

গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অবদান দক্ষিণাঞ্চল বাসীর কাছে স্মরণীয়। সে কারণেই তিনি বরণীয়। তার ত্যাগ শ্রম ও মেধা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের শিবিরে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

খুলনা গেজেট/ এস আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!