খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ব্রাজিলে দুর্ঘটনায় বাসে আগুন, পুড়ে নিহত ৩৮

বাংলাদেশ-ভারত নদী বিরোধ : নতজানু নীতি, বাঁধ নির্মাণের প্রভাব ও স্থায়ী সমাধানে করণীয়

ড. মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ

ত্রাণ, সাহায্য বা ব্যক্তিগত শ্রম দিয়ে বন্যার্তদের আমরা সাময়িকভাবে সহায়তা করতে পারি এবং প্রতি বছর আমরা এই কাজই করে থাকি। কিন্তু দরকার এর একটি স্থায়ী সমাধান। উদাহরণ স্বরূপ, নীল নদের পানি বণ্টন নিয়ে মিসর, সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড রেনেসাঁ ড্যাম নির্মাণের ফলে মিসর ও সুদানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, যা কৃষি ও পানীয় জলের সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার সমাধানে দেশগুলো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, যাতে নীল নদের পানি বণ্টন নিয়ে একটি স্থায়ী ও ন্যায্য সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। আল-জাজিরা বলছে, ‘ব্লু নাইল ড্যাম’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশগুলোর মধ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা সেই বিরোধের অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে সঠিক সমাধান করতে পারছে না। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভারত একের পর এক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করছে, যা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মোটেই কাম্য নয়।

আন্তর্জাতিক আইনে অভিন্ন নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি বেশ কিছু বিধি ও প্রোটোকলের আওতায় পড়ে। মূলত, বাঁধ নির্মাণের সময় আন্তর্জাতিক আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা অনুসরণ করা প্রয়োজন যেমন অন্তর্দেশীয় সমঝোতা, পানির ন্যায্য বণ্টন, পরিবেশগত প্রভাব, তথ্য বিনিময় ও পরামর্শ এবং বিরোধ নিষ্পত্তি।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভারত এই আন্তর্জাতিক আইনের কোনো কিছুই মানছে না। এটি বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশগত স্বার্থের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে এবং আন্তঃদেশীয় সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।ভারতের দাদাগিরি স্বভাবের কারণে, ভারত শুধু বাংলাদেশের সাথে নয়, বরং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্কেও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্ক ও তাদের নিজস্ব সমস্যাগুলির কারণে উত্তেজনাপূর্ণ ও জটিল।এই দেশগুলির সাথে সম্পর্কের জটিলতা আন্তর্জাতিক অঞ্চলে ভারতের একটি পররাষ্ট্রনীতির চিত্র তুলে ধরে যা মাঝে মাঝে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থের প্রতি অগ্রহণযোগ্য মনোভাব প্রদর্শন করে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু অভিন্ন নদী, যেমন গঙ্গা, যমুনা ও তিস্তা নদী। নদীগুলির পানি বণ্টন নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি ও আলোচনা চলমান থাকলেও, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির নতজানু অবস্থান এই বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত সমাধান এনে দিচ্ছে না। ভারতের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তাদের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে ব্যর্থ হচ্ছে।
ভারত এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একের পর এক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করছে, যা বাংলাদেশের জলসম্পদ এবং কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা নদীতে ভারতের নির্মিত বাঁধের ফলে বাংলাদেশে পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ও পানির অভাবের সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

এই বাঁধ নির্মাণগুলির কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা নির্ভরযোগ্য পানি সরবরাহ পাচ্ছে না এবং বন্যার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব পরিস্থিতি বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তার উপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত থেকে এমন আচরণ মোটেই কাম্য নয়। একটি পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। নদীগুলির পানি বণ্টন একটি সংবেদনশীল বিষয়, যা দুই দেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যদি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার আগে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিত, তবে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও মজবুত হতে পারত।

যদি কোনো একটি দেশ অভিন্ন নদীর উপর বাঁধ দেয় এবং এতে অপর দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ওপর দেশের করণীয় পদক্ষেপগুলি হতে পারে: প্রথমত, শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি উত্থাপন করা উচিত। দেশ দুটি তাদের স্বার্থ ও উদ্বেগগুলি আলোচনা করতে পারে এবং একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আদালত বা অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এগুলির মাধ্যমে একটি ন্যায্য সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সম্মেলন অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে রয়েছে, সেগুলির আওতায় অধিকার ও দায়িত্বের বিষয়টি উত্থাপন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হেলসিংকি রুলস বা জাতিসংঘের জলসীমা আইন (UN Watercourses Convention) অনুসারে সমস্যার সমাধান খোঁজা যেতে পারে।

চতুর্থত, দেশটির জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গঠন করা যেতে পারে, যাতে অন্য দেশটি কূটনৈতিক চাপে থাকে এবং সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়।

পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে, যাতে আইনি পথেই সমস্যার সমাধান হয়।

সর্বশেষ, যদি বাঁধটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয় এবং কূটনৈতিক কিংবা আইনি পথে সমাধান সম্ভব না হয়, তবে শেষ অবলম্বন হিসেবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সর্বোচ্চ স্তরের চিন্তা-ভাবনার পরই নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি কার্যকর ও ন্যায্য সমাধানের জন্য ভারতকে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে এবং বাংলাদেশকেও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দুটি দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল ও উন্নত রাখতে হলে, জলসম্পদের সঠিক ও ন্যায্য ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ প্রদান অপরিহার্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। Email: mourtuza@ku.ac.bd

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!