দেশের সবচাইতে বড়ো ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের অনেক বণ্যপ্রাণীই এখন ভালো নেই। ইতোপূর্বে বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, চিতা বাঘসহ চার প্রজাতির পাখি। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের নানা অত্যাচারে কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর শুমারি হয়নি দীর্ঘদিন। ফলে বন বিভাগের কাছে বণ্যপ্রাণীর প্রজাতি ও সংখ্যার হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই। বণ্যপ্রাণী বাড়ছে, নাকি কমছে, তাও অজানা বন বিভাগের। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য হালনাগাদ সংখ্যা ও অবস্থা জানা খুবই জরুরি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন অধ্যাপক ড.আব্দুল্লা হারুন চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক এসব গুরুত্বপূর্ণ বনে বণ্যপ্রাণীর সঠিক ধারনা খুবুই জরুরী। বন সংরক্ষন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য হলেও নির্দিষ্ট সময়ে পরপর বন কর্তাদের প্রাণীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করা উচিত। আর বণ্যপ্রাণীর সঠিক তথ্য না থাকার ফলে যে ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয় তাতে করে ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবেনা বলেও জানান তিনি।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি চার হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি এক হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালে করা সর্বশেষ শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। ২০১৭ সালের সবশেষ সমীক্ষায় কুমিরের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৫০ থেকে ২০৫টি। কুমিরের সংখ্যা স্থিতিশীল। ওই সমীক্ষায় কুমিরের জন্য সাতটি হুমকি চিহ্নিত করা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে জেলেদের জালে আটকা পড়ে কুমিরের বাচ্চার মৃত্যু; মধু আহরণ মৌসুমে মৌয়ালদের চলা ফেরার কারণে ডিমে তা দিতে কুমিরের সমস্যা, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, পশুর নদীতে নৌযান ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য দূষণ, পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলে গুইসাপ এবং ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে পুরুষ কুমির।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, উদবিড়াল বা ভোঁদড়ের সবশেষ শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে হরিণ ছিল এক থেকে দেড় লাখ, কুমির ১৫০ থেকে ২০৫, বানর ৪০ থেকে ৫০ হাজার; শূকর ২০ থেকে ২৫ হাজার; উদবিড়াল ২০ থেকে ২৫ হাজার। এরপর আর এই চারটি বন্যপ্রাণীর কোনো শুমারি হয়নি। ফলে বর্তমান সংখ্যা বা অবস্থা বন বিভাগের জানা নেই।
এ ছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে গুইসাপ, অজগর, কচ্ছপ, পাখি, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। কিন্তু কখনোই সেগুলোর কোনো শুমারি হয়নি। অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর হালনাগাদ সংখ্যা কিংবা বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ ও শূকরের বর্তমান অবস্থা জানা নেই বন বিভাগের। বন্যপ্রাণীগুলো বাড়ছে, নাকি কমছে; তাও অজানা এ সংস্থাটির।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বণ্যপ্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খলের কী অবস্থা এবং বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য সুন্দরবনে কোন প্রাণী কত সংখ্যক রয়েছে, তা জানা খুবই জরুরী। সে জন্য বন বিভাগকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, পণ্য ও পর্যটকবাহী জলযান চলাচলের কারণে নদীর দুই তীর থেকে বন্যপ্রাণী বনের ভেতরের দিকে সরে যেতে পারে। সে জন্য হয়তো আগের তুলনায় প্রাণী কম দেখা যায়।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, বন্য ও জলজ প্রাণী রক্ষায় সুন্দরবনে এখন জিপিএসের সাহায্যে ‘স্মার্ট প্যাট্রোলিং’ চলছে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ চলমান রয়েছে।
খুলনা গেজেট/ টি আই