১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হওয়ার নেপথ্যের কথা জানা যায় বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদের জাতীয় শোক দিবসের শোকাশ্রু নামক একটি প্রকাশনায় “বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি” নিয়ে ড. মসিউর রহমানের লেখনী থেকে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর আমার সহকর্মী জনাব মাহে আলম আমাকে জানায় যে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অন্যদের সাথে আমাকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। তার সাথে দীর্ঘ আলাপ হয় এবং তার পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর সচিব এবং আমার জ্যৈষ্ঠ সহকর্মী জনাব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর সাথে দেখা করি। তার সাথে কাজ করার সময় দেখেছি তিনি সব সময় বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতেন অথবা জ্যৈষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পরামর্শ দিতেন। কখনো নির্দেশ- আদেশের সুর তার কণ্ঠে ছিল না। তার সঙ্গে যখন দেখা করি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়-দায়িত্ব, কার্যপ্রণালী এবং একান্ত সচিবের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তিনি আমাকে সাধারণভাবে অবহিত করেন। সে যাত্রা এখানেই শেষ।
এরপর তিনি লিখেছেন, একদিন জানলাম আমাকে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলির সিদ্ধান্ত হয়েছে, দু’একদিনের মধ্যে সরকারি আদেশ ও পেলাম। পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের নেতারা আমার নাম সুপারিশ করেছে। বাবার চাকরি উপলক্ষে আমি পটুয়াখালীতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সেখানে আমার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব অসংখ্য। সংস্থাপন বিভাগের যুগ্ম সচিব জনাব সৈয়দ হোসেনকে আমি আমার অসুবিধার কথা জানাই। (একসময় আমরা প্রাদেশিক খাদ্য বিভাগে সহকর্মী ছিলাম)। জনাব হোসেন প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করবেন, কিন্তু আমার কথা আমাকেই বলতে হবে। কিছুটা সংশয় এবং ভীতি নিয়ে সৈয়দ হোসেন এর সাথে পুরানো গণভবনে হাজির হই। বঙ্গবন্ধুকে আমি আমার বিব্রতকর অবস্থা জানালাম। বঙ্গবন্ধুর উত্তর সহজ-সরলঃ “তুমি আইন মেনে কাজ করবে, আত্মীয়-অনাত্মীয়তে কিছু আসে-যায় না”। সেখানেই কথা শেষ।
পরে আমার বদলির আদেশটি বাতিল হয়। খুব সম্ভব বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামানের এতে হাত ছিল। তখন আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
বেশ কয়েক মাস পর দ্বিতীয় দফায় আবার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ডাক পড়ল। প্রধানমন্ত্রীর সচিব জনাব রফিক উল্লাহ চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধু আমার সাথে কথা বলবেন। সচিবালয়ে দিনের বেলা সময় হয়নি, তিনি সন্ধ্যায় আবার গণভবনে যেতে বললেন। বর্তমান ফরেন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তখন গণভবন। সন্ধ্যায় গণভবনে উপস্থিত হয়ে বেশি সময় দেরি করতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সামনে আমাকে হাজির করে দিয়ে অন্যরা চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর কথা স্পষ্টঃ “তোমাকে আমি আমার সাথে কাজ করবার জন্য নিতে চাই, তোমার তাতে মত আছে? এখানে কাজের চাপ বেশী, আর সহ্য ক্ষমতা লাগবে- গন্ডারের চামড়া হতে হবে”। “তোমার দ্বিমত আছে”? তার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। বাংলাদেশে এমন কেউ ছিল না যে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার এবং তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করত না। আমি কোনরকম থতমতভাবে বললামঃ আপনার সাথে কাজ করা আমার সৌভাগ্য, আমার ওপর আপনার আস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আপনার সাথে থাকবো। “বঙ্গবন্ধুর উত্তর স্নেহশিক্তঃ “না জেনে শুনে কি আমি তোমাকে পছন্দ করেছি”? এভাবেই বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসাবে আমার কাজ শুরু হয়।
প্রকাশটিতে ড. মসিউর রহমান আরো লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর এত কাছে আসা যে কোনো বাঙালির জন্য বিশেষ সৌভাগ্য। আমার চাকরির বয়স তখন প্রায় সাত বছর। যার অর্ধেক বা তার বেশি সময় কেটেছে শিক্ষানবিশ এবং আন্তঃপ্রদেশ বদলি কর্মসূচিতে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তখন পর্যন্ত আমি কোন সুনাম অর্জন করিনি, সুনাম অর্জনের জন্য এটা ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়। আর আমি চাকরি করেছি এমন সব জায়গায়, যেখানে কেউ যেতে চাইতো না। সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই।
তিনি আরো লিখেছেন, আমাকে একান্ত সচিব হিসেবে বাছাই করবার পেছনে কোন স্পষ্ট রাজনৈতিক বিবেচনা খুঁজে পাই না। ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সাথে সম্পর্ক থাকলেও তা ছিল নীরব সমর্থন। সলিমুল্লাহ হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়নের সময় আপত্তি করি এবং সরে দাঁড়াই। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তখন দু’ একজনের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। শেখ ফজলুল হক মনির সাথেও পরিচয় ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, শেখ মনি আমাকে নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য পরামর্শ দেয়, কিন্ত আমি নিষ্ক্রিয় থাকি।
খুলনা গেজেট/ টি আই