ঢাকার মাঠে এতো গোলক্ষুধা আর কোনো স্ট্রাইকারের ছিল না। মাঠে নামার পরমুহূর্ত থেকেই গোল করার জন্য শিকারী বাঘের মত হণ্যে হয়ে উঠতেন। নানা কৌশলে আদায় করে নিতেন গোল। কতভাবেই যে গোল করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করতে পারেননি।
একজন স্ট্রাইকারের যদি গোল করাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে দেশসেরা হলেন আসলাম। সুঠাম দেহের এ ফুটবলারের পায়ের শটেও ছিল যথেষ্ট পাওয়ার। মাথার কাজ ছিল চমৎকার। তীব্র ও তীক্ষ হেড ওয়ার্ক। হাওয়ায় ভেসে আসা বলে মাথা ছুঁইয়ে গোল করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। ব্যাকভলি নিতে পারতেন দুর্দান্ত। বড় গুণ, ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে পজিশন নিতে পারতেন। হঠাৎ হঠাৎ ফল্স দৌড় দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘাবড়ে দিতেন। দূর থেকে প্রতিপক্ষের জালে আচমকা শটেও গোল করেছেন। সহজাত স্ট্রাইকার না হলেও ছিলেন ওয়ার্কিং স্ট্রাইকার। অসম্ভব একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা ও কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আসলাম।
খুলনার ছেলে শেখ মোহাম্মদ আসলামের জন্ম ১ মার্চ ১৯৫৮। সেই শৈশবেই তিনি খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হন। শুরুতে অ্যাথলেটিক্সের প্রতি ছিল তাঁর যাবতীয় আকর্ষণ। ১০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প, জ্যাভলিন থ্রো ছিল তাঁর ইভেন্ট। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন বিজেএমসি অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিতে।
অ্যাথলেটিক্সের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন ফুটবলে। ১৯৭৪ সালে খুলনা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে টাউন ক্লাবের হয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর খেলেন ওয়াপদায়। এ বছর তাঁর চমকপ্রদ পারফরম্যান্সে রানার্সআপ হয়ে ওয়াপদা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে উন্নীত হয়। ১৯৭৬ সালে ওয়াপদায় খেলার সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
১৯৭৭ সালে তাকে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে দলভুক্ত করা হয়। কোচ আব্দুর রহিম আসলামের অ্যাথলেটিক ফিগার, গতি ও ক্ষিপ্রতার মাঝে সম্ভাবনা খুঁজে পান। শুরুতে তিনি খেলতেন রক্ষণভাগে। উচ্চতা, সুঠাম দেহ, দুর্দান্ত হেডওয়ার্ক, প্রচ- শুটিং পাওয়ার ও ক্ষিপ্রতা দেখে তাঁকে আক্রমণভাগে নিয়ে আসেন কোচ। বদলে যান আসলাম। তাঁকে গোলের নেশায় পেয়ে বসে। এর সঙ্গে যোগ হয় তাঁর গতি, ফুটবল সেন্স, টেম্পারামেন্ট, ধীশক্তি ও পরিশ্রম। তবে বল ধরে সুযোগ তৈরি করে গোল করার চেয়ে গোলের সুযোগ সন্ধানে শিকারীর মত ওঁৎ পেতে থাকতেন। অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দল ভিক্টোরিয়ায় তেমন সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তিন বছর ভিক্টোরিয়ায় খেলার পর ১৯৮০ সালে যোগ দেন বিজেএমসিতে। এরপর আস্তে-ধীরে নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন। শুরুতে বল প্লে, ডজিং, রিসিভিং, স্পটকিক, পেনাল্টি কিক আশানুরূপ ছিল না। নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অধ্যবসায়, শারীরিক দক্ষতা ও ফিটনেস দিয়ে তিনি তাঁর সব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠেন। সে সঙ্গে অল্প দূরত্বে ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ানো, দু’পায়ে প্রচ- শট, চমকপ্রদ হেডিং, অ্যাটাকের সময় পজিশন সেন্স, দূরপাল্লার শট, যে কোনো অবস্থান থেকে গোলে আঘাত, গোলমুখে উড়ে আসা লবগুলোকে নিপুণ হেডের সাহায্যে গোল, ফ্রি কিক, ক্রস পাস, থ্রু পাস থেকে প্রচ- শটে গোল, উইং থেকে দেয়া ক্রস পাসে ট্যাপ করে গোল, প্লেসিংয়ের সাহায্যে গোল, চলন্ত বল থেকে গোলসহ একজন স্ট্রাইকারের সব গুণ তাঁর আয়ত্তে এসে যায়।
প্রথম বছর বিজেএমসির হয়ে ১৩ গোল দিয়ে উঠে আসেন লাইমলাইটে। আর দুটি গোল দিতে পারলে সর্বোচ্চ গোলদাতার ভাগীদার হতে পারতেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিজেএমসির অধিনায়ক ছিলেন। তিনবছর বিজেএমসিতে খেলে ১৯৮৩ সালে মোহামেডানে যোগ দেন। মোহামেডানে খেলার সময় আহত হয়ে লীগের অনেকগুলো ম্যাচ খেলতে পারেননি। ১৯৮৪ সালে আবাহনী ক্রীড়াচক্রে যোগ দেয়ার পর আসলাম যেন পরিপূর্ণভাবে নিজেকে মেলে ধরেন।
এরপর থেকে যাবতীয় রেকর্ড যেন আসলামের পায়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ১৯৮৪ সালে ১৭টি, ১৯৮৫ সালে ১৮টি, ১৯৮৬ সালে ২০টি ও ১৯৮৭ সালে ১৪টি গোল দিয়ে টানা চার বছর লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে নতুন মাইলফলক গড়েন। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের নকিব এই মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হন।
১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ১১ গোল দিয়ে পাঁচবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার নতুন রেকর্ড করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮-৮৯ মৌসুম পর্যন্ত টানা পাঁচ মৌসুমের প্রতিটি লীগে হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন।
১৯৯১-৯২ মৌসুম পর্যন্ত টানা সাত মৌসুম আবাহনীর হয়ে ১০৩টি গোল করেন।
শতাধিক গোল করার এই নজির প্রথম স্থাপন করেন আবাহনীর সালাউদ্দিন।
ভিক্টোরিয়ার হয়ে ১৪টি, বিজেএমসির হয়ে ৩০টি ও মোহামেডানের হয়ে ৭টি গোল করায় ঢাকা লীগে গোলসংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৪টি।
আবাহনীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯৩ সালে তিনি মোহামেডানে যোগ দিয়ে ৭টি গোল করেন। ১৯৯৪ সালে পুনরায় আবাহনীতে ফিরে এসে আরো ১৬টি গোল করে ১৯৯৬ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন।
প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১৭৭টি গোল দিয়ে যে রেকর্ড গড়েছেন, তা অদূর ভবিষ্যতে কারো পক্ষে অতিক্রম করা কঠিন হয়ে পড়বে।
আসলাম পাঁচবার লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও ১৯৮০ সাল থেকে অধিকাংশ সময় ছিলেন নিজ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা।
১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা সাত মৌসুম দেশীয় ফুটবলারদের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
খুরশেদ আলম বাবুলের পর তিনি সাতবার লীগ শিরোপা জয়ী দলের খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়া ছিলেন চারবার ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য।
১৯৮৭ ও ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। ঢাকা লীগে ২০ বছরে ১৮টি লীগ খেলাও একটি বিরল ঘটনা। শৃ´খলা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সর্বোপরি পরিশ্রমের মাধ্যমে সবচেয়ে সফল ও সেরা স্ট্রাইকারে পরিণত হন আসলাম। তৈরি সুযোগ ও হাফ চান্সগুলো কাজে লাগিয়ে গোল করা, দুরূহ সব পজিশন ও অ্যাঙ্গেল থেকে অবিশ্বাস্য গোল, উঁচুতে বল চ্যালেঞ্জে তাঁর সঙ্গে ডিফেন্ডারদের পেরে না ওঠা, সাইড ভলি, ব্যাকভলি, বাইসাইকেল কিক, প্লেসিং শট, লং ও ক্লোজ রেঞ্জে তীব্র শটে গোল করা কিংবা প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে কাঁপিয়ে দিয়ে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন।
ঘরোয়া আসরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন আসলাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ যাবতকালের সেরা ফুটবল আসর ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর অভিষেক হয়।
এরপর থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। একই বছর ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে তিনি অংশ নেন। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত নবম প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে জাতীয় দলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলেন। ০-১ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় বাঁ-পায়ের শটে সমতাসূচক গোল করেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ও বিদেশের মাটিতে এটি তাঁর প্রথম গোল। এ খেলায় বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয়ী হয়।
১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান কাপ ফুটবলে এবং ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের বাছাই পর্বে অংশ নেন। বাছাই পর্বে সেন্টার লাইন থেকে প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক এলাকা হতে প্রায় প্রতিটি ম্যাচে গোল করার মতো সুযোগ সৃষ্টি করেন। কড়া মার্কিং সত্ত্বেও বিপক্ষের রক্ষণব্যুহ ভেদ এবং ফল্স দৌড় দিয়ে বিপক্ষ দলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান।
১৯৮১ সালে ব্যাংককে ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের সহকারী অধিনায়ক, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল এবং ১৯৮২ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নবম এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন।
১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি এবং নেপালের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৭তম মারদেকা ফুটবল প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার সঙ্গে একটি, ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপে স্বাগতিক দলের সঙ্গে একটি, ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ গেমসে ভুটানের সঙ্গে একটি ও মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি গোল করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি ও ফাইনালে ভারতের সঙ্গে একটি গোল করেন।
১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে অংশ নেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে সুইজারল্যান্ডের ভেভে স্পোর্টসের সঙ্গে একটি এবং ফিনল্যান্ডের তুরিনা পলিসেরার সঙ্গে হ্যাটট্রিক করেন। একই বছর সিউলে অনুষ্ঠিত দশম এশিয়ান গেমসে একমাত্র গোলটি আসে তাঁর পা থেকে। এই গোলে বাংলাদেশ নেপালকে হারায়।
১৯৮৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ ‘ব্লু’ দল এবং ১৯৮৯ সালে ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে অংশ নেন। লাল দলের হয়ে থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি এবং ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি গোল করেন। আসলামের হেডে এগিয়ে গেলেও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকে। টাইব্রেকারে বাংলাদেশ লাল দল ৪-৩ গোলে জয়ী হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। টাইব্রেকারেও আসলামের একটি গোল রয়েছে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে তিনি ইরানের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৯০ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে টানা চারটি এশিয়ান গেমসে অংশ নেয়ার গৌরব অর্জন করেন।
১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত পঞ্চম সাফ গেমসে নেপালের সঙ্গে তিনি একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন।
বাংলাদেশ জাতীয় দল, বাংলাদেশ লাল দল, বাফুফে একাদশের হয়ে আসলাম ২৮টি আন্তর্জাতিক গোল করেন। জাতীয় দলের পক্ষে এটি ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড।
আবাহনীর হয়েও আসলাম আন্তর্জাতিক ফুটবলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৮৪ সালে নয়াদিল্লির ডিসিএম ট্রফিতে ভারতের শক্তিশালী দল গুর্খা ব্রিগেডকে ৪-১ গোলে হারায় আবাহনী। দুর্দান্ত খেলেন আসলাম। একাই করেন তিনটি গোল।
১৯৮৫ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপে আসলামের হ্যাটট্রিকে আবাহনী ৮-১ গোলে মালদ্বীপকে হারায়। এই চ্যাম্পিয়নশীপে আবাহনীর হয়ে ৯ গোল দিয়ে শ্রীলংকার স্যান্ডার্স ক্লাবের প্রেমলালের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফিতে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। নাগজি ট্রফির সাড়ে তিন দশকের ইতিহাসে আবাহনীই প্রথম বিদেশি দল হিসেবে এই টুর্নামেন্টে শিরোপা লাভ করে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন আসলাম। প্রথম ম্যাচে কেরালার ক্লাব চ্যাম্পিয়ন ত্রিভান্দ্রামের টাইটোনিয়ামের সঙ্গে আবাহনী ১-০ গোলে জয়ী হয়। খেলার ৮০ মিনিটে রঞ্জিতের দেয়া বল বুক দিয়ে থামিয়ে তীব্র ভলির সাহায্যে গোলরক্ষককে পরাভূত করেন আসলাম। ডাবল লীগের সেমিফাইনালে গোয়ার চ্যাম্পিয়ন এমআরএফ-এর সঙ্গে খেলার ৩২ মিনিটে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে কাজী কামালের একটি ফ্রি কিক অপূর্ব কৌশলে আসলাম ত্বরিৎ গতিতে মাথা ছোঁয়ালে বল গোলরক্ষকের হাতে যায়। বলের এত স্পিড ছিল যে, গোলরক্ষকের হাত ফসকে বল জালে জড়ালে আবাহনী জয়ী হয়। এমআরএফ-এর সঙ্গে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় ম্যাচে আসলামের অবিশ্বাস্য একটি মাইনাস থেকে ছোট মুন্না গোল করলে আবাহনী ফাইনালে ওঠে। ফাইনালে ভারতের ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী সালগাওকরের সঙ্গে লিংকম্যান রুপুর একটি মাইনাস থেকে বল পেয়ে আসলাম দু’দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বাঁ পায়ের তীব্র শটে দেখার মতো একটি গোল করলে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ৪ ম্যাচে ৩ গোল দিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি।
১৯৯১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কোলকাতার শীর্ষ ৩টি ও বাংলাদেশের শীর্ষ ৩টি ক্লাব নিয়ে আয়োজিত বিটিসি ক্লাব কাপে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রেও আসলামের কৃতিত্ব রয়েছে। কোলকাতা মোহামেডান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তিনি একটি করে গোল করেন।
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার আসলাম ফুটবল ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক গোল করেছেন। এর মধ্যে অসংখ্য গোল স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতের সঙ্গে ফাইনাল খেলায় প্রায় ৩৫/৪০ গজ দূর থেকে প্রচ- বাঁক খাওয়ানো শটে গোলরক্ষক অতনু ভট্টাচার্যকে বোকা বানিয়ে যেভাবে বল জালে জড়ান, তাতে উল্লসিত হয়ে ওঠেন ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৫০/৬০ হাজার দর্শক। এক গোলে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ আসলামের গোলে সমতা আনে। অবশ্য টাইব্রেকারে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।
১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলের বাছাই পর্বে সেরা ফুটবলার হন।
১৯৮৬ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের সেমি-ফাইনালে মোহামেডানের সঙ্গে খেলায় আবাহনী ৩-৪ গোলে পিছিয়ে। এ সময় বাবুল বাঁ প্রান্ত থেকে একটি নিখুঁত থ্রো দেন আসলামকে। আসলাম মোহামেডানের ২/৩ জনকে কাটিয়ে ডান পায়ের শটে চমকপ্রদভাবে সেকেন্ডবার ঘেঁষে বল জালে জড়ালে খেলায় সমতা আসে। এ খেলায় শ্রীলংকার প্রেমলাল হ্যাটট্রিক করেন এবং আবাহনী টাইব্রেকারে ৮-৫ গোলে জয়ী হয়।
আসলাম ১৯৯১ সালে কোলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছেন।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৮৪ সালে এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ১৯৯৮ সালে তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ২০০০ সালে আসলামকে দেয়া হয় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচন করে এবং ২০০৫ সালে যে ১০ জন ফুটবলারকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সম্মানিত করে তিনি তাঁদের একজন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্ট্রাইকার হিসেবে আসলামের কিছুটা ঘাটতি ছিল। অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হয়ে ওঠেন। আত্মনিবেদন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি ফুটবলে নতুন দৃষ্টান্ত।
মূল লেখা : দুলাল মাহমুদ, শেখ মো: আসলামের ফেসবুক পেজ থেকে।
খুলনা গেজেট/এএমআর