রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের তদন্তে নাম আসা বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে নিখিল রঞ্জন ধরকে।
রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠায় তাকে (নিখিল রঞ্জন ধর) বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তাকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘পাশাপাশি এ বিষয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসছে একের পর এক জড়িতদের নাম।
প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট থাকা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কর্মরত একাধিক জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে।
পরে প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে। নিখিল রঞ্জন বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাপাখানায় প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর তিনি একটি বা দুটি সেট নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। তবে এই প্রশ্নপত্র ব্যাগে নিয়ে কী করতেন, সেটি এখনও জানা যায়নি।
প্রশ্নপত্র ছাপাখানা থেকে নিয়ে নিখিল কোনো পরীক্ষার্থীকে দিতেন কি না সেটি যাচাই করছে তদন্তকারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ।
শুক্রবার ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা অনেকের নামই পাচ্ছি। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় তাদের কী ভূমিকা থাকত, সেটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটিকে জানাব।’
তিনি বলেন, ‘কমিটির বক্তব্য ও আমাদের তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র নিজের ব্যাগে নেয়ার বিষয়টি কাছে স্বীকার করেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনি দাবি করেছেন, চেক করার পর ওই প্রশ্নের সেটগুলো তিনি ময়লার স্তূপে ফেলে আসতেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ৬ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এই পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭জন।
পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তোলেন পরীক্ষার্থীরা। ডিবির তেজগাঁও বিভাগ বিষয়টি তদন্তে নেমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পায়।
পরীক্ষার দিন ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে। তারা হলেন মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন।
১১ নভেম্বর আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ। তারা হলেন এমদাদুল হক খোকন, সোহেল রানা ও ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবি জাহিদ।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির অফিস অ্যাটেনডেন্ট দেলোয়ার হোসেন ও আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের কাটিংম্যান রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আহসান উল্লাহর ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়াকে। আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর তাদের তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।
তদন্ত সংস্থা ডিবি জানিয়েছে, দেলোয়ার হোসেন ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আহসানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার কাজী শফিকুল ইসলামের অফিসে পিওন হিসেবে চাকরি করতেন। কয়েক মাস পর জানতে পারেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ও পরীক্ষার টেন্ডার পায় আহসানউল্লা। যেহেতু ট্রেজারার পরীক্ষা কমিটিতে থাকতেন, সেহেতু তাকে প্রশ্ন ছাপার বিভিন্ন কাজে নেয়া হতো।
ডিবি জানিয়েছে, এ কাজে নিয়মিত আশুলিয়ায় আহসানিয়া মিশনের নিজস্ব ছাপাখানায় যেতেন দেলোয়ার। সেখানে নজরদারি ও নিরাপত্তার অভাব ছিল। সেই সুযোগে দেলোয়ার লুকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে বের হতেন।
বাহিনীটি বলছে, দেলোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনিই সব কাজ করতেন এবং সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিবার প্রশ্ন ছাপার পর দুই সেট প্রশ্ন তিনি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। তিনি নিজেও অনেকবার নিখিলের ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কোনো প্রশ্ন বা শব্দ করলে দেলোয়ারের চাকরি খা্ওয়ার হুমকি দিতেন নিখিল ধর।
খুলনা গেজেট/এএ