খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ইসি পুনর্গঠনে নির্বাচন কমিশনের সামনে আগামীকাল বেলা ১১টায় এনসিপি’র বিক্ষোভ কর্মসূচি
  এই নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখা যায় না : আখতার হোসেন
  ইসি পুনর্গঠন করে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে : নাহিদ
  চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে না দিতে হাইকোর্টে রিট ; শুনানি রোববার
  অনুর্ধ্ব-১৮ নারী টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রংপুরকে ৩ উইকেটে হারিয়ে খুলনার জয়

পাশবিক বনাম মানবিক

এ এম কামরুল ইসলাম

পাশবিক ও মানবিক দুটি পরস্পর বিরোধী শব্দ। মানবিক শব্দের উৎপত্তি মানব (পুরুষ লিঙ্গ)। মানবী (স্ত্রীলিঙ্গ)। মৌলিক অর্থ মানুষ বা মানব।  ‘মানব’(বিশেষণ পদ, একই সাথে বিশেষ্য পদ। মনু + অ(অণ্)। প্রথম মানব ‘মনু’। Man, Human beings. বিশেষণ পদ ‘মানব’ অর্থ মনু থেকে আগত। মনুসম্বন্ধী। মনুর অপত্য। মানুষের বা মানবের মৌলিক গুণ — নিজের ও পরিপার্শ্বের সকল মানব ও অন্যন্য প্রাণির শারীরিক-মানসিক-আত্মিক সত্তার সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে যথার্থ, যৌক্তিক ও বিজ্ঞানময় চিন্তা-কর্মায়োজনে ব্যাপৃত থাকা। এমন গুণই ‘মানবিক’ গুণের নামান্তর।

‘পাশবিক’ শব্দটি ব্যাকরণগত ভুল। যদিও তা বহুল প্রচলিত। শব্দটি হবে ‘পাশব’। ‘পশু’(দৃশ্ অর্থাৎ দেখা) + উ(কু)। ‘পশু’ শব্দের অর্থ লোম-লাঙ্গুল-যুক্ত চতুষ্পদ প্রাণি। সিংহাদি প্রাণি। ইন্দ্রাদিকীটসহ সকল জীব বা প্রাণি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সকল পশুর মৌলিক গুণ ভ্যেজ্যবস্তু আহরণ এবং বিশেষ ক্ষণে বা লগ্নে স্ত্রী পশু ও পুরুষ পশুর সংগম বা পূর্ণ-মিলন। তা কেবল উত্তর-প্রজন্মের সন্তানের আবির্ভাব ঘটানো। এমনিতেই সকল পশু মৌলিক পরিশুদ্ধ সত্তারই ধারক। কিন্তু মানব-মানবীর ক্ষেত্রে তা ‘গোঁজামিল’-এর ক্ষেত্রকেই প্রলম্বিত করছে। আদিকাল থেকেই  মানবগোষ্ঠী ‘পাশব’ বা ‘পাশবিক’ শব্দটির ‘অপ-প্রয়োগ’ ঘটিয়ে চলেছে। পশু জাতি চিরকালই আত্মদীপ্ত সুন্দর।

এই দুটি শব্দের কিছু সমার্থক বা প্রতিশব্দ আছে। যেমন- পাশবিক, নিষ্ঠুর, বর্বর, নির্দয়, অশিষ্ট, পাশব, পশুধর্মা, পশুবৎ, পশুপ্রকৃতি, নির্বোধ, নির্মম, বর্বরোচিত ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর সুন্দর সুন্দর ইংরেজি শব্দ আছে। যেমন- Brutal, Feral, Brutish, Brute, Ferine, Cruel, Bloody, Inhumane, Unkind, Barbarous , Unkind, Gothic, Savage, Heathen, Merciless, Relentless, Implacable, Inexorable, Crude, Impolite, Ungracious, Ungentle, Canted, Bestial, Hideous, Animal, Doggish, Rotten, Mindless, Foolish, Stupid, Dopey, Ruthless, Grim, Unforgiving ইত্যাদি।

এমনিভাবে ‘মানবিক’ শব্দটির অনেক সমার্থক বা প্রতিশব্দ আছে। যেমন- সদাশয়, পরহিতব্রতী, বদান্য, মনুষ্যত্ব, লোকহিতকামী, লোকহিতকর ইত্যাদি। মানবিক শব্দটির  ইংরেজি অর্থ Humanity, Humanly, Humanities, Benign, Benevolent, Kind, Noble, Altruistic, Bounteous, Generous, Eleemosynary , Bountiful, Boundless, Humanitarian, Public ইত্যাদি।

এই পরস্পর বিরোধী শব্দ দুটির ব্যবহার নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। পৃথিবীতে প্রথমে মানুষ এসেছিল, নাকি পশুপাখি এসেছিল তা আমার জানা নেই। সম্ভবত বিজ্ঞানীরাও তা সঠিকভাবে জানেন না। তবে বিশ্বে মানুষের আগমনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তা একদিকে আশাব্যান্জক, অন্যদিকে হতাশাজনক। ইসলাম ধর্ম মতে পৃথিবীর প্রথম মানুষ ছিলেন হযরত আদম ও হাওয়া। তাঁর দুই ছেলে ছিল। হাবিল আর কাবিল। কিন্তু কাবিল হাবিলকে খুন করেছিল। শুধু ইসলাম ধর্ম নয়। পবিত্র তাওরাত শরীফেও সেই কথা লেখা আছে। খ্রীষ্ট ধর্ম অনুযায়ী আদি মানুষ ছিলেন এডাম ও ইভ। সনাতন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ পড়লেও জানা যায়, পৃথিবীর আদি মানুষ মনু।  প্রাচীন গ্রীস ও রোমের ইতিহাস পড়লেও মানুষের নানা লোমহর্ষক ইতিহাস জানা যায়।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা ও সমাজ চিন্তক আফজাল হোসেন একটি প্রবন্ধে লিখেছেন –
আমরা সকলেই মানুষ। এই দাবী মানুষদের মতো হাত পা, মুখ নাক, কান চোখ- ইত‍্যাদি আছে বলে করা যায় কিন্তু মানুষের কাঁধে কঠিন এক দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে। দিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই। সে দায়িত্ব পালন করে আমরা কে কতখানি মানুষ?

জগতের সবকিছুরই তিনি সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সব সৃষ্টিকে প্রমান করে দেখাতে হয় না- কে কি? সমুদ্র সমুদ্রই- তার স্বভাব নদীর মতো হয় না। শকুন স্বভাব দিয়ে বোঝায়, সে শকুন। ঈগল পাখি আকৃতিতে বেশ বড় সড় কিন্তু ভাগাড়ে তার দেখা মেলে না বলে তাকে শকুন বলে কেউ ভুল করে না। মানুষ জগতের সবচেয়ে ক্ষমতাবান- গুনে মানে, সক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ কিন্তু স্বার্থ বা লোভের ঠ‍্যালায় মানুষ ভাগাড়েও নেমে যেতে পারে।

তিনি আরো লিখেছেন –
মানুষ যা নয়- ভাব দেখিয়ে, ভুলভাল বকে টকে তা প্রমাণের চেষ্টা করে। অনেক মানুষ অহরহই প্রমাণ দিতে চায়- সে ধর্মপ্রাণ। বলে বলেই প্রমাণ দিতে চায়- তাদের বলার সাথে করার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিক একই কায়দায় বহুজন প্রমাণ দিতে চায়, অতি বড় আকৃতির দেশপ্রেমিক তারা। এই অতি প্রমাণ করতে চাওয়াতেই বাধে যতরকমের বিপত্তি।

জনাব আফজাল হোসেনের সাথে একমত পোষণ করে বলছি- মানুষ বড় বড় অপরাধ করে দায় চাপে পশুর উপর। একজন নারীকে অন্য মানুষ ধর্ষণ করে মেরে ফেললে মানুষে তা দেখে বলে- মেয়েটির উপর ‘পাশবিক নির্যাতন’ হয়েছে। অর্থাৎ এই নির্যাতনকে পশুর মত নির্যাতন বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে একটা পুরুষ পশু অন্য একটা নারী পশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে এমন তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবুও কেন মানুষ ধর্ষণ করে হত্যাকান্ডটির দায় পশুর নামে চাপিয়ে দেয়? আমার মনে হয়, পশুরা এসব শুনে হাসাহাসি করে বলে- হায়রে মানুষ, তোদের চেয়ে আমরা বহুগুণে ভাল। ওই মেয়েটির মৃত্যুকে ‘মানবিক’ বললে সঠিক হবে।

পৃথিবীর সকল সৃষ্টির নিজ নিজ ধর্ম আছে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সেইসব ধর্ম তারা আজীবন যথাযথভাবে পালন করে। তাদের ধর্ম থেকে তারা চুল পরিমাণ বিচ্যুত হয় না। বৃক্ষ তার জীবদ্দশায় এক সেকেন্ডের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রাখে না। বরং মানুষ তাদের কেটেকুটে উজাড় করে। সাগর- নদী কখনো পানি ও বাষ্প আটকে দেয় না। কিন্তু মানুষে নদীর পানি নোংরা করে। মাঝে মাঝে তাদের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। সূর্য-চন্দ্র আজ পর্যন্ত একদিনও তার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি। বাতাস যদি তার ধর্ম বাদ দিয়ে এক ঘন্টার জন্য কোন কারণে ধর্মচ্যুত হয় তাহলে সমগ্র সৃষ্টির কী দশা হবে? অথবা বাতাস যদি বলে- আমি আমার আদি ধর্ম বাদ দিয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করলাম। এখন থেকে আমি শুধু আমার ধর্মের মানুষের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করবো। অথবা বাতাস যদি মহাদেশ, উপমহাদেশ বা কোন স্বতন্ত্র দেশে বিভক্ত হয়ে বলে- আমি এখন থেকে শুধু আমার দেশ ব্যতীত অন্য কোন দেশে অক্সিজেন দিবো না। তাহলে কি হবে?

কিন্তু বাতাস তা কখনোই বলে নি বা কখনোই বলবে না। কারণ বাতাস প্রকৃত ধার্মিক। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া ধর্ম সে যথাযথভাবে পালন করে। তাই বলে সে কখনো ধর্ম পালনের বড়াই করে না। কারণ সৃষ্টিকর্তার দেওয়া ধর্ম অমান্য করা যায়, এমন কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। তার অভিধানে ধর্মচ্যুত বলে কোন শব্দ নেই। তাকে হেদায়েত করতে সৃষ্টিকর্তার কোন দূত পাঠানো লাগে নি। সেই বাতাসকে ধর্মচ্যুত করতে জন্মলগ্ন থেকে মানুষে দূষিত করে আসছে।

মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা উপাধি দিয়ে, সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ করে চলেছে সেই আদিকাল থেকে। সৃষ্টির শুরুতে সৃষ্টিকর্তা অন্যন্য সৃষ্টির মতো মানুষের জন্যেও নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলে দিয়েছিলেন এবং সমগ্র পৃথিবীকে তার জীবদ্দশায় চারণভূমি হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তথাকথিত ‘সেরা মানুষই’ বার বার তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। তাই সৃষ্টিকর্তা মানুষকে তার ধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে যুগে যুগে দূত পাঠাতে শুরু করেন। কিন্তু মানুষ সেইসব দূতদেরও ভাগাভাগি করে নিলো এবং তাঁদের বার্তা ভুল বুঝে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত সেইসব মহামানবদের বানিয়ে নিলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তাঁদের হিতোপদেশ নিজের মতো প্রয়োগ করে সৃষ্টি করলো চরম বিপত্তি। তাই সৃষ্টিকর্তা শেষ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে দূত পাঠানো বন্ধ করলেন।

মানুষ তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী মানুষ মারার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরী করে নিজের স্বার্থে অপপ্রয়োগ করছে। সৃষ্টিকর্তার সাধের সৃষ্টিকে করছে কলুষিত। হয়তো এভাবেই একদিন মানুষই মহাপ্রলয় ডেকে আনবে। তখনও মানুষ তাদের অপকর্মেকে হালাল করার জন্য ‘পাশবিক’ বলে চালিয়ে দিবে।

সৃষ্টিকর্তা সমগ্র সৃষ্টির জন্য একটি পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সকল সৃষ্টি সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি পৃথিবীর আনুগত্য স্বীকার করে আসছে। কিন্তু সৃষ্টির  তথাকথিত ‘সেরা মানুষ জাতি’ পৃথিবীকে খণ্ডবিখণ্ড করে ভাগাভাগি করে নিলো। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে খুন করতে শুরু করলো। সেই মানুষ ভাল কাজকে বলে ‘মানবিক’ আর খারাপ কাজকে বলে ‘পাশবিক’। এ যেন নিজের সাথে নিজেই উপহাস করা।

তাই একদিন সকল পশুপাখি ও সৃষ্টি একত্রিত হয়ে তাদের মধ্যে কোন খারাপ কাজ দেখলেই হয়তো বলবে- এই  ‘মানবিক’ কাজটা যে করেছে, নিশ্চিত সে একজন ‘মানুষ’ (?)।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!