চারদিকে পানিতে টইটম্বুর। মাঝে আটকে আছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা কয়েক হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইম মুভার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা থেকে মিরসরাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। বিকল হয়ে পড়েছে বহু গাড়ির ইঞ্জিন। যে গাড়ি এক দিনে আনলোড করে আবার ফেরার কথা, তা চার দিন পরও পৌঁছাতেই পারেনি গন্তব্যে। যানজটের মুখ থেকে পেছনে ফিরবে, নেই সেই সুযোগও। যানজটে আটকা পড়েছে বন্যাদুর্গতদের জন্য নিয়ে যাওয়া ত্রাণবাহী ট্রাক-লরি ও ছোটখাটো যানবাহনও।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, টানা বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কমেছে পণ্য খালাস কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বন্দরে গত বৃহস্পতিবার থেকে পণ্য খালাসের হার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কম হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ডুবে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও পণ্য খালাস নেননি।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯০ শতাংশই ব্যবস্থাপনা করে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোগুলো। রপ্তানিকারকরা কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে পণ্য এনে ডিপোর ছাউনিতে রাখেন। সেখানে কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষে এসব পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য বন্দর থেকে ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। আর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হওয়া কনটেইনারের ৯৬ শতাংশই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে আনা-নেওয়া করা হয়। বাকি ৩ শতাংশ রেলপথে ও ১ শতাংশের কম নৌপথে পরিবহন হয়।
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির হিসাবে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার টিইইউস কনটেইনার খালাস হয়। কিন্তু বৃষ্টি শুরুর পর ২১ আগস্ট চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ঢুকেছে ৩ হাজার ৩৪৩ টিইইউস। তবে বুধবার তা কমে গেছে প্রায় ১ হাজারের মতো। সেদিন রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ঢুকেছে ২ হাজার ৩৩২ টিইইউস। শুক্রবার ঢুকেছে ২ হাজার ৫৬০ টিইইউস। আর শনিবার মাত্র ৯৮৫টি গাড়ি ঢুকেছে ডিপোগুলোতে। শনিবার পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৩৫ টিইইউস কনটেইনার রপ্তানি বোঝাই করে জাহাজীকরণের অপেক্ষায় ছিল। ডিপোগুলোতে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে ৪৯ হাজার ১৮৯ টিইইউস আমদানি হওয়া পণ্যবাহী কনটেইনার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্যার পানির ওঠায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলতে পারছে না। এ কারণে বন্দর থেকে কনটইেনার ডেলিভারি ব্যাহত হচ্ছে। তবে বন্দরের ভেতরে জেটিতে থাকা জাহাজে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক। বৃষ্টির কারণে বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলো থেকে খোলা পণ্য খালাসও ব্যাহত হচ্ছে। ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃষ্টি হলে বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ থাকে।
চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি সোহেল সরকার বলেন, ফেনীর লালপুল এলাকায় মহাসড়কে পানি ওঠায় বৃহস্পতিবার থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ভারী যানবাহন পানি ঠেলে পার হতে পারলেও শনিবার বিকেল ৩টার দিকে একেবারেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ফেনী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খাইরুল আলম সুজন বলেন, ডিপো থেকে বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সড়ক ডুবে যাওয়ায় ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্য আসতে পারছে না। আগের তুলনায় রপ্তানিপণ্য তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানিমুখী পণ্য আটকা পড়েছে। এসব পণ্য কখন এসে পৌঁছাবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক সময়ে তিন হাজারের বেশি ট্রাক রপ্তানিপণ্য নিয়ে আসে।
এদিকে, আন্তঃজেলা মালপত্র পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহম্মদ বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান আটকা পড়েছে। গ্যাসচালিত বেশিরভাগ ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ইঞ্জিন বর্তমানে বিকল হয়ে পড়েছে। আশা করা হচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোববার রাতের দিকে স্বাভাবিক হতে পারে যান চলাচল।
চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রান্সপোর্ট মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আল নাদিম বলেন, কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে বন্যা; আমাদের ওপর খুবই ধকল যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় আমাদের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ হাজার প্রাইম মুভার আটকা পড়েছে। অনেক গাড়ি গর্তে পড়েছে; বেশিরভাগের ইঞ্জিন পানিতে ভিজেছে। সব মিলিয়ে আমাদের কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজি উল্লাহ বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের প্রায় ২ হাজার গাড়ি আটকা পড়েছে বলে খবর পেয়েছি। শুধু গাড়িই আটকা পড়েছে বিষয়টি তা নয়; আমাদের প্রায় তার সঙ্গে ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ হাজার চালক-হেলপার আটকা পড়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক ও কন্ট্রাকটর অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গোলাম রসুল বলেন, আমাদের সংগঠনের পরিবহন ব্যবস্থা সাধারণত নগরকেন্দ্রিক। নগরে পানি ওঠায় কিছু কিছু এলাকায় পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন কোনো গাড়িই বন্ধ নেই। সব চলছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, রেললাইন ডুবে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার পর থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ ট্রেন চলাচল সচল হবে এ বিষয়ে এখনো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
এদিকে, রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সবজির বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সুযোগে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, তিন দিন ধরে চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ। এ কারণে পণ্যবাহী গাড়ি চট্টগ্রামের আড়তে আসেনি। চট্টগ্রাম থেকে পণ্য নিয়ে দেশের অন্য কোথাও যেতে পারেনি। পণ্যের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ায় চাকতাই-খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে দাম কিছুটা বেড়েছে।