এক ঝলকে তাঁকে দেখলে মনে হবে, ক্রিকেট ব্যাট নয়, তাঁর হাতে বরং ডাম্বেল-বারবেলই বেশি ভাল মানায়। ভারোত্তোলন বা কোনও কুস্তির আখড়াতেও দিব্যি মানিয়ে যাবেন। বিরাট কোহলি বা হার্দিক পাণ্ড্যের মতো ক্রিকেটার যেখানে ফিটনেসের আদর্শ উদাহরণ, সেখানে ১১০ কেজির এই ক্রিকেটারকে দেখে মনে হতে পারে নিতান্তই বেমানান। কিন্তু তা নয়। আজম খান অন্য ধাতুতে গড়া। ক্রিকেটে খুচরো রান নেওয়ার বদলে যে চার-ছয় মেরেও সফল হওয়া যায়, সেটা পাকিস্তান সুপার লিগের প্রতিটি ম্যাচে দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ বারের পিএসএল মাতিয়ে দিচ্ছেন আজম।
ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে নামটা নতুন মনে হতেই পারে। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট এখন তাদের অধিনায়ক বাবর আজমকে বাদ দিয়ে এই আজমে মেতেছে। তিনি মইন খানের ছেলে। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতারদের দুনিয়ায় পাকিস্তান দলে উইকেটকিপিংয়ের জন্যে আলাদা করে পরিচিত হয়েছিলেন মইন। উইকেটের পিছনে প্রতি বলের পরে নাগাড়ে তাঁর চিৎকার এবং স্লেজিংয়ের সামনে সেই সময়ে প্রায় সব ক্রিকেটারকেই পড়তে হয়েছে। সেই মইনেরই ছেলে আজম। বাবার মতো তিনিও উইকেটকিপার-ব্যাটার। তবে বাবা যে রকম শান্ত মাথায় ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করতেন, তার উল্টো আজম। তিনি পছন্দ করেন মারকুটে ব্যাটিং। পছন্দের ক্রিকেটার যে ক্রিস গেল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পিএসএলে ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের হয়ে খেলেন আজম। দলের কোচ তাঁর বাবাই। এ বারের পিএসএলে ৯টি ম্যাচে ২৮০ রান করেছেন। তার মধ্যে কোয়েট্টা গ্ল্যাডিয়েটর্সের বিরুদ্ধে ৪২ বলে ৯৭ রানের একটি ঝোড়ো ইনিংসও রয়েছে। সম্প্রতি উইকেটকিপিং করতে গিয়ে চোট পেয়েছেন। তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে দ্রুত ফিরে আসবেন।
ওজন বেশি হওয়ার কারণে কম কটাক্ষ শুনতে হয়নি আজমকে। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়কের ছেলে হিসাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করলেও চেহারার জন্য হাসির পাত্র হয়েছেন তিনি। ২০১৯ সাল থেকে পিএসএলে খেলা শুরু করেছেন। প্রতি বছরই কাঁড়ি কাঁড়ি রান করেছেন। কিন্তু কটাক্ষ পিছু ছাড়েনি। ঠিক করেন, এ বার ওজন কমাতে হবে। সেই মতোই অনুশীলন শুরু করেন শেহজার মহম্মদের কাছে।
এই শেহজার আবার পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার হানিফ মহম্মদের নাতি। ফলে এখানেও ছিল ক্রিকেটীয় সংযোগ। শেহজার খুশি মনেই অনুশীলন করাতে থাকেন আজমকে। প্রথম ধাপে ১৪ কেজি, পরের ধাপে আরও ১৬ কেজি। অর্থাৎ ৩০ কেজি ওজন কমিয়েছেন আজম। ১৪০ কেজি থেকে নেমে এসেছেন ১১০ কেজিতে। ওজন কমাতে গিয়ে শুরুর দিকে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন আজম। পেশি আচমকা শক্ত হয়ে যাওয়ায় ক্রিকেট খেলতে অসুবিধা হচ্ছিল। বড় বড় শট মারতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে শেহজারের বুদ্ধিমত্তায় পেশির জোর আগের জায়গায় ফিরে আসে। গেলের মতো মাঠের বাইরে বল ফেলতে এখন আর আজমের কোনও অসুবিধা হয় না।
কিন্তু কঠিন সময় পেরোনোটা কঠিন ছিল, স্বীকার করেছেন আজম। বছরখানেক আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “কথাগুলো শুনলে খুব খারাপ লাগত। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম ব্যাট দিয়ে সবার সমালোচনার জবাব দিতে। সেটাই করেছি।” কিন্তু শেহজারের স্পষ্ট নির্দেশ, ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যেতে গেলে ওজন বাড়ানো চলবে না। ফলে আজমের জীবন এখন কঠোর বিধিনিষেধে মোড়া। নিজেই বলেছেন, “কোনও ধরনের ভাজাভুজি খাবার খাই না। যে খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে সেগুলো খাই। কালো কফি খাই। এ ভাবেই ১৪ কেজি কমিয়েছি। চাই না আর কেউ আমাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলুক।”
পাকিস্তানের হয়ে ২০২১-এ টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। তিনটি ম্যাচ খেলার পর আর সুযোগ পাননি। বলার মতো পারফরম্যান্সও অবশ্য নেই। মাত্র ছ’রান রয়েছে নামের পাশে। উইকেটকিপার হিসাবেও আহামরি কিছু করেননি। কিন্তু জাতীয় দলে ফেরার জন্য পিএসএলকেই বেছে নিয়েছেন। চলতি মরসুমের ফর্ম নির্বাচকদের বাধ্য করেছে তাঁকে নিয়ে ভাবতে।
পাকিস্তানের উঠতি প্রতিভা আজম ভালবাসেন গিটার বাজাতে। কারও কাছে শিখে নয়, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখে নিজে নিজেই বাজাতে শিখে গিয়েছেন। তাঁর মতে, ম্যাচের আগে গিটার বাজানো চাপ কমাতে সাহায্য করে। তিনি বলিউডের গানেরও বিরাট ভক্ত। দেশীয় গায়ক আতিফ ইসলামের গানও রয়েছে মোবাইলে। আজমের আশা, ক্লাবের জার্সিতে নয়, এ বার দেশের জার্সিতে নিজের প্রতিভা চিনিয়ে দেওয়া।
খুলনা গেজেট/ এসজেড