পঁচে দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে সাতক্ষীরা প্রাণসায়ের খালের পানি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ সায়ের খানের দুপাড় দিয়ে চলাচল করে। খালের পশ্চিম পাড়ের রাস্তা দিয়ে সকালে প্রাতঃভ্রমণে বের হয় শতাধিক নারী-পুরুষ। ফলে সাতক্ষীরার প্রাণ প্রাণসায়ের খালের পানি পঁচে গিয়ে পৌরবাসীর মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে দাঁড়িয়েছে ।
সাতক্ষীরা শহরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৫০ সালের দিকে সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ও শহরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য একটি খাল খনন করেন। মরিচ্চাপ নদের সঙ্গে বেতনা নদীর সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এ খালটি খনন করা হয়। এল্লারচর থেকে খেজুরডাঙ্গী পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার লম্বা খনন করা খালটি জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর নাম অনুসারে প্রাণসায়ের খাল হিসেবে পরিচিতি পায়। সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া খালটি একসময় শহরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এ খাল। এর মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠেছিল জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও।
প্রৌরবাসির অভিযোগ, প্রয়োজনীয় রক্ষানাবেক্ষনের অভাবে এই খালটি এখন সাতক্ষীরা পৌরবাসির মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। প্রবাহ না থাকায় বর্তমানে খালের পানি পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে চারিদিকে। যে কারণে খালের দু’পাশ দিয়ে মানুষের চলাচল করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রাণসায়ের খাল পাড়ের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন সকালে শতাধিক নারী-পুরুষ প্রাতঃভ্রমনে বের হন। পানি পঁচে দুগন্ধ হওয়ায় খালের পাড় দিয়ে হাটা চলার সময় পথচারীদের নাকে কাপড় দিয়ে হাটতে হচ্ছে। খালের বদ্ধ পঁচা পানিতে জন্ম নিচ্ছে মশা। ফলে সাতক্ষীরার প্রাণ প্রাণসায়ের খাল এখন মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে।
শহরের রাধানগর এলাকার বাসিন্দা জি.এম. মনিরুল ইসলাম মিনি বলেন, ভরাট হয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালে এটি পুনঃখনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ি খননও করা হয়। কিন্তু নানা অনিয়ম ও সঠিক তত্ত্বাবধায়নের অভাবে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরা শহরের প্রাণসায়ের খাল পুনঃখননে কোনো কাজে আসেনি। অনিয়মের কারণে খাল পুনঃখননে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর ২০২১ সাল থেকে খননকাজ বন্ধ হয়ে আছে। অন্যদিকে খননকৃত প্রাণসায়ের খালটি আবারো আগের রূপে ফিরে গেছে। প্রাণসায়ের খালে এখন শহরবাসীর নিক্ষিপ্ত বর্জ্য ও কচুরিপানায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বদ্ধ পানি পঁচে গিয়ে ও বর্জ্যে শহরের পরিবেশ মারাত্মক দূষণ হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, সরকার ১০ কোটি ব্যয়ে সাতক্ষীরা প্রাণসায়ের খালটি পুনঃখনন শুরু করে ২০২০ সালে। কিন্তু শুরু থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়সারাভাবে খনন করে। সে সময় সাতক্ষীরায় নাগরিকদের পক্ষ থেকে মানববন্ধন ও মিছিল সমাবেশও করা হয়। কিন্ত কোনো ফল হয়নি। ৫৫-৬০ শতাংশ পুনঃখনন করার পর ২০২১ সালে অজ্ঞাত কারণে প্রাণসায়ের খননকাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত আর খনন হলো না শহরের ঐতিহ্যবাহী প্রাণসায়ের খালটি। এতে সরকারের ৯-১০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। কিন্তু প্রাণসায়ের খাল পুনঃখনন কোনো কাজে লাগলো না। অন্যদিকে দুই মুখে বাঁধ দেয়ায় প্রাণসায়ের খালে জমে থাকা বদ্ধ পানিতে শহরবাসী ও সুলতানপুর বড়বাজারের নিক্ষিপ্ত বর্জ্যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্রাণসায়ের খালের পাশের রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হলে দুর্গন্ধে পথচারীদের মুখে রুমাল দিতে হয়।
শহরের চালতেতলা এলাকার বাসিন্দা সাইফুল হোসেন বাবু বলেন, প্রাণসায়ের খাল ভরাট ও দখল হওয়ার পর নতুন করে খনন করা হয়। কিন্তু যেভাবে খনন করা হয়েছে, তাতে প্রাণসায়ের প্রাণ ফিরে পাওয়া তো দূরের কথা, শুধু অর্থের অপচয় হয়েছে মাত্র। নকশা অনুযায়ী এই খাল কাটার পর উপরিভাগের প্রস্থ ৭৫ থেকে ৮০ ফুট হতে হবে। গভীরতা ৬ থেকে ৮ ফুট ও তলদেশের প্রস্থ হবে ২৫ ফুট। তা না করে যেনতেনভাবে পানি না শুকিয়েই খাল খননের নামে এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে কাদা তুলে পাড়ে রাখা হয়েছিল। যা পওে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আবার খালের মধ্যে পড়ে ভরাট হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকার বাসিন্দা ওকালত আলী সানা বলেন, প্রতিদিন ভোরে শহরে বসবারত কয়েকশ মানুষ খাল পাড়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করে। খালের বদ্ধ পানি পঁচে কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অধিকাংশ সময় পথচারীদের নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটাচলা করতে হয়। খালের বদ্ধ পঁচা পানি বর্তমানে মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যা শহরবাসীর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দ্রুত খালে জমে থাকা শেওলা অপসারণ করে ও সুলতানপুর বড় বাজারের ব্যবসায়ীসহ খালপাড়ে বসবাসকারীদের ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এবিষয়ে জানার জন্য সাতক্ষীরা পৗরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র কাজী ফিরোজ হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এবিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
খুলনা গেজেট/ টিএ